সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফার রহ. শ্রেষ্ঠত্ব

প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান

॥ এক ॥
ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সমকালীন যুগ থেকে নিয়ে সর্বযুগে স্বীকৃত। মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনীষীগণ তাঁর অনন্য অসাধারণ এসব কৃতিত্ব ও অবদানের কথা এবং ইলমের ময়দানে তাঁর দান ও অনুদানের কথা অবলীলায় স্বীকার করে গেছেন। ইলম ও আখলাকে, জ্ঞানে ও গুণে এবং বোধ ও বুদ্ধিতে এমন বিরল প্রতিভার অধিকারী সব্যসাচী মানুষ মানব ইতিহাসে খুব কমই জন্মেছে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ফিকহের ময়দানের শাহেনশাহ, হাদীসের ময়দানের শাহসাওয়ার এবং অন্ধকার রাতের একজন বিনিদ্র সাধক। মুুসলিম উম্মাহ এই কিংবদন্তির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
যে মানুষটির মেধা ও প্রজ্ঞায় মুসলিম উম্মাহ আলোকিত হয়েছে, যার অসাধারণ চিন্তাশক্তিতে হাজারো জটিল সমস্যার সমাধানের পথ খুলেছে, যে মানুষটি তাঁর অনন্য দক্ষতায় পবিত্র কোরআন এবং হাদীস থেকে মাসআলা বের করার পন্থা শিখিয়েছেন, যিনি হাজার হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাব লিখেছেন; সেই মানুষটির ব্যাপারে যখন বলা হয় তিনি হাদীস জানেন না এবং বুঝেন না তখন বিবেকের দংশন এবং আত্মার দহন নিজেকে কুরে কুরে খায়। আজ এত বছর পরে সমালোচকদের অভিযোগের কারণে যখন আমাদেরকে এই কথা লিখতে হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ও হাদীস জানতেন তখন লজ্জায় নিজেকে ছোট মনে হয়। এটা কীসের সাথে কীসের তুলনা! যে মানুষটি হাদীস অন্বেষণ করার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে সফর করেছেন, যিনি যুগ যুগ ধরে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে হাদীস থেকে মাসআলা ইস্তিম্বাত করেছেন; তার ব্যাপারে হাদীস না জানার অভিযোগ তোলা চরম আপত্তিকর এবং হাস্যকর। এটা একেবারেই নিচু মানসিকতার পরিচায়ক। হিংসা, বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতদুষ্ট উদ্দেশ্য প্রণোদিত হীন মানসিকতা ছাড়া কোনোভাবেই এ ধরনের অসত্য ও অবাস্তব অভিযোগ তোলা সম্ভব নয়। আর এটাই সত্য, যারা অভিযোগ তোলেন এই কারণেই তোলেন। যদিও তাদের এই অভিযোগ অবাস্তব বিষয় নিয়ে অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই নয় এবং তাদের এই অভিযোগের কারণে হানাফী মাযহাব এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতো মহীরুহের কিছুই আসে যায় না, তারপরও যেন হানাফী মাযহাব অনুসারীরা ভ্রান্তির শিকার না হন এবং হীনমন্যতায় না ভোগেন সে জন্য এখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর হাদীসি অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। মহান আল্লাহই তাওফীক দাতা।
হাদীস অন্বেষণে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ওইসব মুহাদ্দিসীনে কেরামের একজন যারা হাদীস অন্বেষণ করার জন্য দূরদূরান্তে সফর করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর বয়স যখন ২০ বছর তখন থেকে তিনি ব্যাপকহারে হাদীস খুঁজতে শুরু করেন। আবু হানীফা (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ৮০ হিজরীতে। তখন পযন্ত সুবিন্যস্তভাবে হাদীসের কোনো কিতাব লেখা হয়নি। সবাই হাদীস সংগ্রহের জন্য দেশ-দেশান্তর সফর করতেন। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের ছাত্রদের কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহে ব্যস্ত থাকতেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস সংগ্রহে বের হয়ে পড়েন। আবু হানীফা (রহ.)-এর হাদীস সংগ্রহের এই বিষয়টিকে বড় বড় মুহাদ্দিস এবং হাদীস বর্ণণাকারীদের জীবনী নিয়ে গ্রন্থপ্রণেতাগণও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদেরই একজন আল্লামা হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) (৭৪৮হি.) ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে লিখেন, ‘ইরাকের আলেম ফকীহুল মিল্লাত ইমাম আবু হানীফা (রহ.)..। যিনি হাদীস ও আছার সংগ্রহের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন এবং এর জন্য সফর করেছেন। আর ফিকহের সূক্ষ্মতা এবং চিন্তাশক্তির তীক্ষ্মতার ক্ষেত্রে আবু হানীফাই হলেন প্রথম সংকলক ও প্রবর্তক। ফিকহের জগতে মানুষ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এরই পরিবারভুক্ত।’Ñ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, শামসুদ্দীন আয-যাহাবী খ: ৫ পৃ: ২২২, মাকতবাতুস সফা, কায়রো, মিশর, প্রথম সংস্করণ ১৪২৪ হি.)
অন্যত্র হাফেয যাহাবী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণ করেছেন। একশ’ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে তিনি হাদীস সংগ্রহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন।’Ñ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ: ০৫ পৃ: ২২৫)
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস সংগ্রহের জন্য ইরাক থেকে সুদূর মক্কায় সফর করে আতা বিন আবী রাবাহ (রহ.) (১১৪হি.)-এর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। সে ব্যাপারে যাহাবী (রহ.) ‘মানাকেবে আবী হানীফা’ নামক গ্রন্থে লিখেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) মক্কায় আতা বিন আবু রাবাহর কাছে হাদীস শুনেছেন। আবু হানীফা (রহ.) বলেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আমি আতা থেকে উত্তম কাউকে দেখিনি।’Ñ (মানাকেবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহেবাইহি, আয-যাহাবী পৃ:১১, মিশর থেকে প্রকাশিত; মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.), পৃ: ১৭, দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বৈরুত, লেবানন; তারীখে বাগদাদ, খতীব আল-বাগদাদী খ: ১৩ পৃ:৩৩৯)
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কতটা অগ্রগামী ও আগ্রহী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তারই সমকালীন সহপাঠী ইমাম মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.)-এর কথা থেকে। তিনি বলেন, ‘আমি আবু হানীফা (রহ.)-এর সাথে হাদীস অন্বেষণ করেছি, তিনি আমার থেকে আগে বেড়ে গেছেন। তাঁর সাথে যুহদে (আল্লাহর ইবাদত) লিপ্ত হয়েছি, সেখানেও তিনি অগ্রগামী হয়ে গেছেন। অতঃপর তাঁর সাথে ইলমে ফিকহ অন্বেষণ করেছি, এক্ষেত্রে তিনি আমার চেয়ে কত উঁচুতে উন্নীত হয়েছেন তা আপনারাই প্রত্যক্ষ করছেন।’Ñ (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ২০; মানাকেবে আবী হানীফা, পৃ: ২৭)
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.) এমন একজন হাদীস বিশারদ যার ব্যাপারে হাফেয আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী (রহ.) বলেন, কোনো হাদীস নিয়ে যখন ইমাম শো’বা (১৬০হি.) ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)(১৬১হি.)-এর মাঝে মতানৈক্য হতো তখন তারা সে হাদীসের ব্যাপারে মিসআর বিন কেদামের সিদ্ধান্তানুযায়ী সমাধানে উপনীত হতেন। ইমাম শো’বা ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)-কে বলা হয় ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস’। তাদের মতো হাদীস বিশেষজ্ঞ যে মিসআর বিন কেদামকে সমাধানের মাধ্যম ও পাল্লা বানান, সেই মিসআর বিন কেদাম ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি আমার থেকে হাদীস সংগ্রহে আগে বেড়ে গেছেন!! তাহলে হাদীসের জগতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।Ñ (আল মুহাদ্দিসুল ফাসিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়াঈ, মাখতুত, হায়দারাবাদ দাক্কান; সূত্র- ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী, পৃ: ১৬৬, মীর মুহাম্মাদ কুতুবখানা করাচী)
সংগৃহীত হাদীসের সংখ্যা এবং ‘কিতাবুল আছার’
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) দেশ-দেশান্তরে সফর করে যে পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার সংখ্যাই হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ (রহ.) ‘মানাকিবুল ইমামিল আযম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ৪০ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেছেন।’Ñ (ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪)
এ ব্যাপারে অন্যত্র আবু ইয়াহইয়া যাকারিয়া বিন ইয়াহইয়া নিশাপুরী (রহ.) (২৯৮হি.) সনদসহ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন। আবু হানীফা (রহ.) বলেন, ‘আমার কাছে হাদীসের বিশাল এক ভা-ার আছে, আমি সেখান থেকে শুধু এমন হাদীসগুলোই বের করেছি যার দ্বারা মানুষের উপকার হবে। (অর্থাৎ- আমি সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীসই বর্ণনা করেছি)। প্রাগুক্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
শামছ তালুকদার ৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৩৫ পিএম says : 0
Absolutely right writer
Total Reply(0)
মোঃ ফরহাদ হোসেন ২২ মার্চ, ২০১৮, ১২:১০ পিএম says : 0
আপনি যাহা লিখেছেন তাতে আমি মুগ্ধ। আমার মনের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পেলাম। কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর খুজে পাইনি সেটা হলো আমার মনের একটা প্রশ্ন হলো ইমাম আবুহানিফা এবং ইমাম বোখারীর মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল কি না ????
Total Reply(1)
Ashraf Ali Sohagh ৩ জুলাই, ২০২১, ৫:৪৩ পিএম says : 0
ইমাম বোখারির অন্যতম ওস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম , যাঁর সনদে ইমাম বুখারি বেশির ভাগ 'সুলাসিয়াত' হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানিফা -এর ছাত্র। সে হিসেবে ইমাম বোখারী ইমাম আবু হানিফার ছাত্রের ছাত্র
আবু নাঈম মুহাম্মদ হোসাইন ৯ মে, ২০২১, ১১:২৩ পিএম says : 0
অসাধারণ লিখনী
Total Reply(0)
Khadem ৩ নভেম্বর, ২০২১, ১১:১৭ পিএম says : 0
শ্বৈর শ্বাসকের বিরুদ্ধে যায় এমন হাদিস সংগ্রহ করে তা Print করার দুস্বাদ্ধ কারো ছিলোনা। তাই ৪০ হাজার হাদিসের মধ‍্য থেকে যে সংকলিত হাদিস তা শ্বৈর শ্বাসকের মজির্ মতই হয়েছে। তার পরেও আবু হানিফাকে যখন বসে আনতে পারিনি তখন তাঁকে জেলে ভরেছে। তা নাহলে হাদিসের চিত্র অন‍্য রকম হতো। আমাদের কাছে যেসব হাদিস বর্তমান আছে তার সবগুলোই একই ভাবে আমাদের কাছে এসেছে। প্রকৃতরুপ আল্লাহ ভালো জানেন। আমার প্রশ্ন ইমাম বুখারী কেনো একটা হাদিসও ইমাম আবু হানিফার Ref. আনেননি
Total Reply(0)
Khadem ৩ নভেম্বর, ২০২১, ১১:২৯ পিএম says : 0
ইমাম আবু হানিফা জেলে ছিলেন। কি অপরাধ ছিলো। বুখারী কেনো ইমাম আবু হানিফার Ref. এ হাদিস বর্ননা করলেননা। এই অভিযোগ এসেছে। এর উত্তর কি?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন