যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) রুট। ভোগান্তি কমানোর এ প্রকল্প ৯ বছর ধরে উল্টো সীমাহীন ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে। কবে এ ভোগান্তি শেষ হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে আগামী বছরের ডিসেম্বরেই এ প্রকল্পর কাজ শেষ হবে। ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, কাজের মোট অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আমাদের আর দুটো কন্ট্রাক্ট ডিপো আর ফিডার রোডস এগুলো শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আর প্রকল্পের মোট অগ্রগতি হচ্ছে ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, যেখানে বিআরটি প্রকল্পটি হচ্ছে এটি আরবান এরিয়া নয়। এটা বাণিজ্যিক ও ন্যাশনাল করিডোর। এখানে বিআরটি প্রকল্প হওয়ার কথা না। অথচ সেখানেই হয়েছে এই প্রকল্পটি। সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটি হয়েছে। এই প্রকল্পে দীর্ঘ সময় ব্যয় করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এখানে পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। এসব প্রকল্পে সরকারের উন্নয়ন দর্শনের কোনো গাইডলাইন নেই। ফলে জনদুর্ভোগ জন যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। এটা একটা অভিশাপ।
ভুক্তভোগিরা জানান, প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার সড়ক এখনও খানাখন্দে ভরা। বড় বড় গর্তে জমে আছে পানি। মূল সড়কের উপরে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। দিনের বেশিরভাগ সময়ই লেগে থাকে যানজট। যা কখনো ২/৩ ঘণ্টাও স্থায়ী হয়। এতে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। রোগী পারাপারে অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গত কয়েক বছর ধরে এই ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আগে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিআরটির কারণে মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রও বিআরটি প্রকল্পের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারাও মানুষের ভোগান্তি দূর করতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জানা গেছে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট ‘বিআরটি’ প্রকল্পের কাজ ৪ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৯ বছরেও শেষ হয়নি তা। কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশ কাজের অগ্রগতি হয়েছে। পুরো কাজ সমাপ্ত হতে আরও কয়েক বছর লাগবে বলে ধারণা করছেন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এতে সহসাই যানজট আর জনদুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না। বিআরটি প্রকল্পের এই কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। বিআরটি চালু হলে এর সুফল মিলবে কি না তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও গাজীপুর এলাকার যানজট নিরসনে ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন পায় ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট)। তখন এ প্রজেক্টে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ দিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ২০২১ সালেও এই কাজ সমাপ্ত হয়নি। গত ৯ বছরে প্রকল্প এগিয়েছে মাত্র ৬৩ শতাংশ। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। আগামী বছরের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার সংশোধিত সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নতুন নির্ধারিত সময় ২০২২-এর ডিসেম্বরেও শেষ হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা ১৮০ থেকে ১৯০ ফুট। অন্যদিকে গাজীপুর অংশের কোথাও কোথাও সড়কের প্রশস্ততা ৬০ থেকে ৬৫ ফুট। বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ব্যস্ততম এই সড়কটি সরু হয়ে যায়। এতে প্রশস্ততা কোথাও কোথাও অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। সড়কের মাঝ বরাবর বিআরটি প্রকল্পের পিলার বসানো হয়েছে। সড়কের পাশে ও উপরে পড়ে আছে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন কাজ না হলেও তা সংস্কার করা হচ্ছে না। প্রকল্প চলাকালীন এসব সড়ক সংস্কারের দায়িত্ব প্রকল্পের ঠিকাদারদের। এজন্য বরাদ্দও আছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব সংস্কারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রকল্পের ১৬ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন-প্রশস্তের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। সাড়ে ৪ কিলোমিটার উড়াল সড়ক, বিআরটি লেন, স্টেশন ও ১০ লেনের একটি সেতু নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। গত ৯ বছরে এ দুই সংস্থার প্রকল্প পরিচালক হয়ে এসেছেন ৭ থেকে ৮ জন। তবুও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু ও সমাপ্ত হয়নি।
ভুক্তভোগীরা জানান, ২০১৮ সালের শুরু থেকে সড়কে ভোগান্তি আর দুর্ভোগ বেড়েছে। সড়কের উপরে কাজের কারণে বিভিন্ন অংশে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। এসব গর্তে পানি জমে যায়। এতে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে। গর্তে বাসের চাকা আটকে পড়ে। দিনভরই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। বৃষ্টি হলে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় গ্রীষ্মকালে ধুলায় অন্ধকার থাকে পুরো এলাকা। বর্ষায় কাদা, পানি ও খানাখন্দে ভরা পুরো সড়ক। এখনও সেই অবস্থা বিরাজমান। উপর মহল থেকে চাপ দিলে সড়কের ভাঙা অংশ ইট দিয়ে কোনোমতে মেরামত করা হয়। কদিন পরে সেই ইটও ভেঙে একাকার হয়ে যায়। এ অবস্থা চলছে গত চার বছর ধরে। এতে করে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান গুনতে গুনতে ধ্বংসের পথে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করে চলে গেছেন।
ভুক্তভোগি বাস চালক ও পরিবহন শ্রমিকরা জানান, এক সময় গাজীপুর রুটে বাসের ব্যবসা লাভজনক ছিল। গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সারাদিনে একটি বাস দুটির বেশি ট্রিপ দিতে পারে না। যানজটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রীষ্মকালে যাত্রীরা ধুলায় অতিষ্ঠ। এখন কাদা ও খানাখন্দে বাসসহ সব ধরেনর যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে হেলেদুলে চলে। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
এদিকে, গত ৩ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি জানান, বর্তমানে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগামী বছরের ডিসেম্বরে বাস র্যাপিড ট্রানজিট ‘বিআরটি’ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
বিআরটি প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক, ৬টি ফ্লাইওভার ও ২৫টি বিআরটি স্টেশনসহ মোট ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার করিডোর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হবে। এ করিডোরে দুইটি সংরক্ষিত বিআরটি লেন, চারটি মিক্সড ট্রাফিক লেন, দুইটি অযান্ত্রিক লেন, পথচারীদের জন্য ফুটপাথের ব্যবস্থা থাকবে। বিআরটি করিডোরের উভয়পার্শ্বে যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ৬৫টি সংযোগ সড়ক ইতিমধ্যে উন্নয়ন করা হয়েছে। মূল করিডোর ও সংযোগ সড়কসমূহের উভয়পার্শ্বের পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সংরক্ষিত লেনে নির্দিষ্ট সময় পরপর অধিক যাত্রীধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ১২ মিটার দীর্ঘ স্ট্যান্ডার্ড এসি বাস চলাচল করবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য স্টেশনে লিফটের ব্যবস্থা থাকবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটিই হবে ঢাকা ও গাজীপুর মহানগরীর মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম বাসভিত্তিক আরামদায়ক গণপরিবহন। বিআরটি কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া নিশ্চিতভাবে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছাতে পারবে। প্রতি ঘণ্টায় উভয় দিকে ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হবে।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেট (বিআরটি) প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রকল্পের মূল কাজ ২০১৮ সালে শুরু করতে পেরেছি। এর আগে ডিজাইন করতে সময় লেগেছে। যন্ত্রপাতি আনতেও অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। রাস্তার দুইদিকে ড্রেন করতে হয়েছে। অনেক সময় বৃষ্টির কারণে কাজের ক্ষতি হয়েছে। মূল কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন একটা সময় দেরি হয়নি। এর মধ্যে ঠিকাদারদের ফান্ড নিয়েও কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। আমরা কাজটিকে দ্রুত এগিয়ে নিতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। অনেক বড় একটা কাজ শেষ করার জন্য কিছুটা সময় লাগছে। আশা করি ২০২২ সালের ডিসেম্বর কিংবা তার আগেই পুরো কাজ সমাপ্ত করতে পারব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন