মাত্র এক সপ্তাহ আগে ৯ সদস্যের সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশশের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আফগানিস্তানের তালেবান দখলের পর এ অঞ্চলে ইসলামী মৌলবাদের উচ্চতর ঝুঁকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি তার ভার্চ্যুয়াল বক্তৃতায় চীন, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সদস্যদেরকে ‘মৌলবাদ ও সহিংসতার’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মৌলবাদ ঠেকাতে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা অনুসরণ করতে বলেছেন।
যদিও মোদি এক্ষেত্রে সহজ শ্বাস নিতে পারেন। কারণ, ভারতীয় মুসলিমরা ঐতিহাসিকভাবে বৈশ্বিক জিহাদ আন্দোলন থেকে দূরে অবস্থান করে। ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে মুজাহিদীনের প্রতিরোধের জন্য ভারতীয় মুসলিমরা বা পরবর্তী আল-কায়েদা-তালেবান দখলদারিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি তারা। তারা আইএসআইএসের বিষাক্ত প্রভাবের বিরুদ্ধেও সমানভাবে নিরাসক্ত প্রমাণিত হয়েছেন যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে বিস্ময়কর।
কিন্তু, মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বর্ণভিত্তিক হিন্দু ভোট সংহত করার জন্য মুসলিমদের সহিংস মৌলবাদী এবং অবাঞ্ছিত হিসেবে উপস্থাপন করে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বাস্তবে, তথাকথিত মুসলিম সংখ্যালঘু চরমপন্থীদের চেয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের সহিংসতা ভারতের জন্য এখন অনেক বড় হুমকি।
ইসলামী উগ্রপন্থার হুমকির বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন মোদি। কিন্তু ভারতের জন্য আসল হুমকি তার নিজের দলের ক্রমবর্ধমান নির্লজ্জ, সহিংস মুসলিম বিরোধী ধর্মান্ধতা, যা উস্কে দেওয়া উগ্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে উদ্ভূত। ভারতে এখন হিন্দুদের মুসলিম হত্যা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে এখন খুব কমই খবর ছাপা হয়। মোদির দলের ‘গো-মাংস এবং আন্তঃধর্ম প্রেম ও বিয়ের বিরুদ্ধে নতুন আইন’ এখন হিন্দু সজাগ গোষ্ঠীকে মুসলিমদের ওপর দায়মুক্তভাবে আক্রমণের অনুমতি দেয়।
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মৌলবাদীদের নৃশংস বিদ্বেষমূলক নিগ্রহ এবং বক্তৃতা একটি পরিবর্তিত ভারতে মুসলিমদের নতুন সামাজিক অনুক্রমের প্রতি একটি নিয়মিত সতর্কতা প্রদান করে, যেখানে মুসলমানরা বড়জোড় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার আশা করতে পারে। এটাই ‘নতুন ভারতে’ নতুন স্বাভাবিকতা (মোদির সমর্থকরা শব্দগুলোকে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী হিন্দু নেতার অধীনে ভারতের স্বর্ণযুগের শর্টহ্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করেন, যিনি দুর্নীতির অবসান ঘটাচ্ছেন, সমৃদ্ধি আনছেন এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলিমদের তাদের উপযুক্ত স্থান দেখিয়ে দিচ্ছেন।)
২০১৪ সালে যখন মোদি জাতীয় নির্বাচন করেছিলেন, তখন তিনি ‘সবার জন্য উন্নয়ন’ সেøাগানসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ভারতে তার গত ৫ বছর ধরে তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। করোনা মহামারীর ক্ষতি এবং কষ্টের স্মৃতি এখনও দেশটির জনগণের মধ্যে রয়ে গেছে। মোদির হিন্দু ভোটারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী ‘কৃষক বিক্ষোভ’ এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ ৬ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনে মধ্যে বিজেপির কাছে মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণামূলক প্রচারণা বাড়িয়ে ভোট টানা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
মোদির দলের জন্য, প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধী প্রচারাভিযানগুলো তার কার্যকলাপ ও শাসন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে এবং তথাকথিত বিপন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠদের সুরক্ষার জন্য নির্বাচনকে গণভোটে পরিণত করতে সহায়তা করে। এবার তার মূল বার্তা হল, সকলের জন্য উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ মুসলিমরা, যারা ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ, তারা বাকি ৮০ শতাংশ হিন্দুর প্রাপ্য উন্নতির ফল খেয়ে ফেলছে।
যেখানে উগ্রপন্থাকে মোকাবিলা করার জন্য মোদি বিশ্বজনীন ফোরামে ‘যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারার’ প্রয়োজনে উচ্চারণ করেছেন, সেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের গণহত্যা করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মের স্ব-নিযুক্ত ত্রাণকর্তাদের ছোট গোষ্ঠীগুলো একাকি মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করছে, এমন ভিডিওগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। এ হামলার অনেকগুলোই এখন মুসলিমদের জীবিকা ও ব্যবসা থেকে বিতাড়িত করে হিন্দু দখলে নেয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে মোদি সরকার এখন আদিবাসীদের কৃষিকাজের জন্য জমি দেওয়ার অজুহাতে মুসলিমদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে। গত সপ্তাহে নির্মম উচ্ছেদ অভিযানে বহু দরিদ্র মুসলিমকে হত্যা করা হয়। মুসলিম নিধনের ক্ষেত্রে মোদি কি এবার জুডেনবয়কটের পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছেন, যা ১৯৩৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিরা শুরু করেছিল এবং ধীরে ধীরে তা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে ইহুদি গণহত্যায় রপান্তরিত হয়েছিল? এক বছরেরও বেশি সময় পর বাইরের দুনিয়াতে পা রাখা মোদির প্রতি এটি একটি উত্থাপনযোগ্য প্রশ্ন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন