‘এবার বুঝি ডাল-ভাত খাওয়াও বন্ধ হবে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ বেশিরভাগ সময় ডাল-ভাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখন তো দেখছি সেটা কেনারও জো নেই। মাছ-গোশত কেনা তো অনেকটা দুঃসপ্ন।’ মধ্যবয়সী আব্দুল কাইয়ুম। নিত্যপণ্য কিনতে বাজারে এসে এভাবেই বিড় বিড় করে নিজের হতাশা প্রকাশ করছিলেন। শুধু আব্দুল কাইয়ুম নয়; এরকম হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষের মাথায় হাত পড়েছে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে। প্রতিদিনই যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে একেকটি পণ্য।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এক লিটার ভোজ্যতেল কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৬০-১৬৫ টাকা। বছরজুড়ে কিছুটা কম থাকা ব্রয়লার মুরগি এখন কিনতে হচ্ছে ১৭০ টকায়। চিনির বাজার ঠিক রাখতে সরকারের দেওয়া নির্ধারিত দাম অমান্য করে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। আটা-ময়দার দামও কয়েক মাস ধরে বাড়তি। পিছিয়ে নেই চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দামও। কাঁচাবাজারে বেশিরভাগ সবজি ৫০ টাকার নিচে মিলছে না। মাছের বাজারেও দামের আগুন ছড়াচ্ছে। সব মিলে প্রায় সব পেশার মানুষের মাথায় হাত। বাড়তি দরে পণ্য কিনে তারা চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন।
এদিকে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর একই সময়ের তুলনায় চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, মাছ-গোশতসহ ১৭ ধরনের পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে কেজিতে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫৪ দশমিক ২৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এছাড়া মাসের ব্যবধানে বাজারে ১৩ ধরনের পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সর্বশেষ সাত দিনের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে ১২ পণ্যের দাম বেড়েছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল প্রতিকেজি সরুচাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সাত দিন আগেও ৬৫-৬৬ টাকা ছিল। এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের মধ্যে পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা, এক মাস আগে ৭০০ টাকা ও এক বছর আগে ছিল ৫১৫ টাকা। বড় দানার মশুর ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা, যা এক মাস আগে ৮০ টাকা ও এক বছর আগে ছিল ৭০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫-১৭০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ১৪০ টাকা ও এক বছর আগে ১২০ টাকা। চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা, যা এক মাস আগে ৮০ টাকা ও গত বছর একই সময়ে ৬৫ টাকা ছিল। নতুন করে আবার পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, যা সাত দিন আগে ছিল ৪৫ টাকা। প্রতিকেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা, যা সাত দিন আগে ছিল ৪০ টাকা।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের আগাম সবজির মধ্যে প্রতিকেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকা। প্রতি কেজি গাজর ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা। প্রতি কেজি ঝিঙা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা, করলা ৬০-৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০-৬০ টাকা, পটল ৫০-৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০-৭০ টাকা ও বরবটি ৮০-৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতারা বলেন, এখন দেশের মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনে খেতে হচ্ছে। বাজারে সব ধরনের পণ্য আছে তাহলে দাম এত বেশি কেন সেদিকে এবার নজর দিতে হবে। কী কারণে বাড়ছে, তা বের করে কেউ কারসাজি করলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভোক্তার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাবে। কারণ যে টাকা বেতন পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। পাশাপাশি প্রতিদিন যদি এভাবে পণ্যের দাম বাড়ে তাহলে কোনোভাবেই আয়ের সঙ্গে ব্যয় মানিয়ে চলা যাচ্ছে না। হতাশা ও অস্বস্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জানায়, বাজারে সব ধরনের পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাকে পণ্য কিনতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সেজন্য বাজারে কঠোর মনিটরিং করা খুব দরকার। যাতে ভোক্তা সুফল পায়। পাশাপাশি যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে তা কমাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কে কোন পণ্য নিয়ে কারসাজি করে তা চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, জনসংখ্যা বা চাহিদা অনুপাতে পণ্যের মজুদ কেমন রাখতে হয়, কোন দেশ সেটি কিভাবে রাখে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও দাম কেন বাড়তি সেদিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, নিম্ন আয়ের মানুষের অনেকটা ভরসা জায়গায় থাকা টিসিবির নিত্যপণ্যের ট্রাকের কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে এক সপ্তাহের বেশি সময়। খোলা বাজারে টিসিবি পণ্য বিক্রি কিছুটা বাড়ালেও চাহিদা তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক আসার আগেই তৈরি হয় মানুষের দীর্ঘ লাইন। বর্তমানে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও বাধ্য হচ্ছে এসব লাইনে দাঁড়াতে। অনেক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না পণ্য। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় বিক্রি। ফলে প্রতিদিন খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষকে। টিসিবির ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ভোক্তাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে টিসিবি এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করছে। আগে এটি ছিল মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ। চাহিদা বাড়ায় ট্রাকসেল বাড়ানো হয়েছে। টিসিবির সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেলে পণ্য বিক্রির পরিমাণও পর্যায়ক্রমে বাড়বে।’
সাধারণের জন্য ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির আওতা বাড়াতে টিসিবির কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বর্তমানে টিসিবির ডিলার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। রমজানের সময় ৫০০টি ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হয়। এছাড়া সারা বছর ৩০০ থেকে ৪০০টি ট্রাকে বিক্রি চলে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন