অ ধ্যা প ক হা সা ন আ ব দু ল কা ই য়ু ম
হিজরি বর্ষ গণনার প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এই মহররম মাসের দশম দিবস আশুরা নামে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পরিচিত। যুগে যুগে সংঘটিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য ম-িত ঘটনার নীরব সাক্ষী এই আশুরা। আল্লাহ জাল্লাশানুহু সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন নূরে মুহম্মদী সৃষ্টির মাধ্যমে আশুরাতে। নূরে মুহম্মদীর বিশ্লেষণ করা সম্ভব অধুনা বিগব্যাং থিওরির গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে। নূরে মুহম্মদীর নূর থেকে আল্লাহ জাল্লাশানুহু একে একে সকল সৃষ্টি বিকশিত করেন। আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেন। সেই সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল আশুরাতে। মানব জাতির আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের দেহে প্রাণের স্পন্দন এনেছিলেন আশুরাতে। পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টিপাত হয়েছিল আশুরাতে। আদম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামসহ আল্লাহর নির্দেশে জান্নাতে বসবাস করছিলেন। আল্লাহ জাল্লাশানুহু ইরশাদ করেন : হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখানে ইচ্ছে স্বচ্ছন্দে আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষটির নিকটবর্তী হয়ো না, যদি নিকটবর্তী হও তাহলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩৫)।
কিন্তু ইবলিস শয়তানের প্ররোচনায় তাদের পদস্খলন ঘটল। তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হলো। হযরত আদম আলাইহিস সালাম এসে পড়লেন শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং বিবি হাওয়া আলাইহিস সালাম এসে পড়লেন লোহিত সাগরের তীরে মরুময় সমতল ভূমি জেদ্দায়। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে তারা তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে তওবা ইস্তিগফার করলেন। অতঃপর আল্লাহ তওবা কবুল করলেন। এই তওবা কবুলের দিনটি ছিল আশুরা। হযরত আদম আলাইহিস সালাম প্রায় ৯৬০ বছর বয়সে যেদিন ইন্তেকাল করেন সেদিন ছিল আশুরা। হযরত আদম আলাইহিস সালাম শ্রীলঙ্কার যে পাহাড় চূড়ায় দীর্ঘ সাড়ে তিনশ বছর ধরে অবস্থান অবস্থায় তওবা ইস্তিগফার করেছিলেন সে পাহাড় এখনো অটুট রয়েছে। তাকে বলা হয় এ্যাডামস্্ পিক, পুর্তগিজরা এর নামকরণ করে পিকোডি আদম, হিন্দু ও বৌদ্ধরা একে বলে শ্রী শ্রী পাদম এবং মসলিমগণ বলে বাবা আদম পাদম। মা হাওয়া আলাইহিস সালামের মাজার শরিফ জেদ্দায়। এই মাজারের দেয়াল গাত্রে লেখা রয়েছে মাকবারা উম্মুনা হাওয়া। ২০০৬ খৃস্টাব্দে পুত্র আলহাজ আরিফ বিল্লাহ মিঠু ও স্ত্রী আল হাজ্জা মাহমুদা বেগম মায়াসহ এই মাজার শরিফ আমি (বর্তমান লেখক) জিয়ারত করেছি। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সময় যে মহাপ্লাবন হয় সেই মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি একটা জাহাজ বানিয়ে তাতে প্রত্যেক প্রকারের জীবের এক এক জোড়া এবং ঈমান আনয়নকারী মানুষগণসহ আরোহণ করেন। ৪০ দিন পর প্লাবন শেষে যেদিন তিনি জাহাজ থেকে জুদী পাহাড়ে অবতরণ করেন সেদিন ছিল আশুরা।
হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যেদিন জালিম নমরুদের অগ্নিকু- হতে আল্লাহর রহমতে উদ্ধার পেয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা।
এমনিভাবে হযরত ইউনূস ‘আলাইহিস সালাম ৪০ দিন দজলা নদীতে মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহ জাল্লাশানুহুর রহমতে উদ্ধার লাভ হয় সেদিন ছিল আশুরা। হযরত ইউনূস আলাইহিস সালামের ৪০ বছর পর পিতা হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সঙ্গে মিলিত হওয়া, হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালামের হারানো সা¤্রাজ্য ফিরে পাওয়া, হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উম্মত বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের কারাগার থেকে উদ্ধার করে লোহিত সাগর পাড়ি দেয়া প্রভৃতি শত শত ঘটনার নীরব সাক্ষী আশুরা। কিয়ামত হবে ভবিষ্যতের কোনো এক আশুরা দিবসে। আশুরা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার কারণে। ৬১ হিজরি মোতাবেক ৬৮০ খৃস্টাব্দের আশুরার দিনে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় নাতি হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহুতায়ালা আনহু শাহাদাত লাভের অনন্য ও মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহুতায়ালা আনহু নিজেকে কোরবানি করে ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহুতায়ালা আনহু কারবালা প্রান্তরে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেন তা যুগে যুগে বিশ্বমানব মননে বৈপ্লবিক চেতনা সঞ্চারিত করে আসছে। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম হুসাইন (রা.) সম্পর্কে এক কাসিদায় বলেছেন : শাহ্ আস্ত হুসাইন/পাদশাহ্্ আস্ত হুসাইন/দীন্্ আস্ত হুসাইন/ দীনেপনাহ্্ আস্ত হুসাইন-হুসাইন রাজা/হুসাইন স¤্রাট/ হুসাইন দীন (ইসলাম)/ হুসাইন ইসলামের আশ্রয়।
আশুরা আসে মানবতার বিজয় বারতা নিয়ে ইতিহাসের পাঠদান করার জন্য। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী কুতবুল আলম পীরে কামিল হযরত মাওলানা শাহ্সুফী তোয়াজউদ্দিন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : সবর ও শোকরের মহাশিল্প আমরা আশুরা থেকে পেয়ে থাকি। এ দিবস আত্ম আবিষ্কার করার তাগিদ দেয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন : ফিরে এল আজ সেই মুহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া কুন্দন চাহিনা। কবির এই উচ্চারণে আশুরাতে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হওয়ার তাগিদ লক্ষ্য করা যায়।
আশুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র দিন। শিরক ও বিদআতের আবরণে এই পবিত্র দিনটাকে আমরা যেন আচ্ছাদিত না করি। আশুরার সিয়ামের মর্যাদা অনেক। নফল সিয়ামের মধ্যে সর্বোত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম। যুগ পরম্পরায় আশুরার সিয়াম পালিত হয়ে আসছে। রমাদানের সিয়াম বিধান নাজিল হলে আশুরার সিয়াম সম্পর্কে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, যার ইচ্ছে হয় আশুরার সিয়াম পালন করবে।
লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন