শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলা সাহিত্যে মহররম

প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ম. মী জা নু র র হ মা ন
আরবি মাস ‘মহররম’-এর ১০ তারিখ প্রতিটি মুসলমান ব্যক্তি-মানসে শোক দিবস হিসেবে চিহ্নিত। এই দিন ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা মরুভূমির প্রান্তরে হজরত মোহাম্মদ (সা.) দৌহিত্র হোসেন (রা)কে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে এজিদ। অতঃপর ইসলামের ইতিহাসে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং স্বৈরশাসনাধীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্মরণাতীতকালের সেই বিয়োগান্তক কাহিনীভিত্তিক ইতিহাস বাংলা গদ্যে, কাব্য-সাহিত্যে ‘মহরম’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। মীর মোশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) তাঁর সুলিখিত গদ্য-কাব্যে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসটি রচনা করেন। এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা অদ্যাবধি অবিস্মরণীয়। সেই উপন্যাসের অংশবিশেষ নীচে দেয়া হলÑ
কারবালার পর-
রে পথিক! রে পাষানহৃদয় পথিক! কি লোভে এত ত্রস্তে দৌড়িতেছ? কি আশায় খ-িত শির বর্ষার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ? এ শিরে- হায়! এ খ-িত শিরে তোমার প্রয়োজন কি?
সীমার! এ শিরে তোমার আবশ্যক কি? হোসেন তোমার কি করিয়াছিল? তুমি ত আর জয়নবের রূপে মোহিত হইয়াছিলে না? জয়নব এমাম হাসানের স্ত্রী, হোসেনের শির তোমার বর্শাগ্রে কেন? তুমিই বা সেই শির বর্শাগ্রে লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে এত বেগে দৌড়িতেছ কেন? যাইতেছই বা কোথায়?
সীমার! একটু দাঁড়াও! আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাও, কার সাধ্য তোমার গমনে বাধা দেয়? কার ক্ষমতা তোমাকে কিছু বলে? একটু দাঁড়াও, এ শিরে তোমার স্বার্থ কি? খ-িত শিরে তোমার স্বার্থ কি? খ-িত শিরে তোমার প্রয়োজন কি?
অর্থ?
হায় রে অর্থ! হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতে সকল অনর্থের মূল। জীবের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নিতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরী ভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ! বিবাদ-বিসংবাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জন, বিবাদ, বিনাশ এ সকলই তোমার জন্য। সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি। তোমার কি মোহিনী শক্তি! কি মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম, রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত-মহাব্যস্ত-প্রাণওষ্ঠাগত। তোমাবই জন্য কেবলমাত্র তোমারই কারণে-কতজনে তীর, তরবারি, বন্দুক, বর্শা, গোলাগুলি অকাতরে বক্ষ পাতিয়া বুকে ধরিতেছে। তোমারই জন্য অগাধ জলে ডুবিতেছে, ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করিতেছে, পর্বত শিখরে আরোহণ করিতেছে। রক্ত, মাংশপেশি, পরমাণু সংযোজিত শরীর তোমারই জন্য শূন্যে উড়াইতেছে। কি কুহক! কি মায়া॥ কি মোহিনী শক্তি!!! তোমার কুহকে কে না পড়িতেছে? তুমি দূর হও! তুমি দূর হও!!! কবির কল্পনার পথ হইতে একেবারে দূর হও! কবির কল্পনার পথ হইতে একবারে দূর হও। কবির চিন্তাধারা হইতে একেবারে সরিয়া যাও। তোমার নাম করিয়া কথা কহিতে অঙ্গ শিহরিয়া ওঠে। তোমারই জন্য প্রভু হোসেন সীমার হস্তে খ-িত!- রাক্ষসি! তোমারই জন্য খ-িত শির বর্শাগ্রে বিদ্ধ!...”
মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ কাহিনী নির্মাণ সম্পর্কে মহাশ্মশান মহাকাব্যের ¯্রষ্টা মহাকবি কায়কোবাদের মতে ঐতিহাসিক সত্য থেকে তথা বিচ্যুতি তখা “ইসলামের হৃদয়-পন্জরে তীব্র শেলাঘাত।” তাই তিনি “মহরম শরীফ বা আত্মবিসর্জন” (মুসলমান কবি-রচিত জাতীয় আথ্যান -কাব্য পৃ৪৪৯। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা- ড. কাজী আব্দুল মান্নান)।
মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ওরফে মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৭- ১৯৫১) “মহরম শরীফ বা আত্মবিসর্জন” রচনা করেছিলেন শুধু মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ কাহিনীর সত্য ইতিহাসটিকে উপস্থাপন করার মানসে। প্রতিটি সর্গে প্রথম থেকে চতুর্থ সর্গ পর্যন্ত তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে অতি চমৎকারভাবে ঐতিহাসিক বিবরণাদি ফুটায়ে তুলেছেন। এখানে তিনি নাটকীয় রূপদান করেছেন প্রত্যেকটি সর্গে যাতে পাঠক সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক সত্যটি চিত্রায়িত দেখতে পান আপন মনের অন্দরমহলে। যেমন প্রথম সর্গ [কারবালা মোআল্লা;-ফোরাত নদী-তীর; মহরম মাসের ৩ তারিখ- শুক্রবার ৬১ হিজরী]
এই কি কারবালা সেই?-এই সেই স্থান? এই
সেই মহামরু? হেরিলে যাহারে
অশ্রু ঝরে দু’নয়নে কেঁদে ওঠে প্রাণ?
কত কথা পড়ে মনে, শিরায় শিরা
প্রচ- অনল-স্রোত হয় প্রবাহিত;
প্রাণের নিভৃত কক্ষে- হৃদয়ে- কন্দরে
কি যে এক শোক- স্মৃতি হয় উচ্ছসিত!Ñ
Ñযেই স্থানে, কি বলিব বুক ফেটে যায়,
মহাম্মদ মোস্তাফার আদরের ধন,
ফাতেমার হৃদি-রতœ নয়নের মণি,
বীরশ্রেষ্ঠ মোর্তজার ¯েœহের নন্দন,
ইশ্লাম ধর্মের আলোÑসৌন্দর্যের খনি
হোসেন তাপস শ্রেষ্ঠ, আপন শোণিতে
প্রক্ষালিত মোশ্লেমের পাপতাপরাশি
দিয়াছিলা ধর্মযুদ্ধে আপনার প্রাণ,
এই কি কার্বালা সেইÑএই সে শ্মশান!...” এইভাবে ৫ পৃষ্ঠা থেকে ১৫৮ পৃষ্ঠাব্যাপী মহাকবি কায়কোবাদ চিত্রায়িত করেছেন সমগ্র হৃদয়বিদারক মর্মন্তদ কাহিনীটি।
সবার উপরে জ্বালাময়ী আখরে লিখেছেন ‘মোহররম’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।
ওরে বাঙলার মুসলিম, তোরা কাঁদ্!
এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃ মোহররমের চাঁদ॥
এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখতের লোভে এসেছে এজিদ কম্বখ্তের বেশে!
এসেছে “সীমার”, এসেছে, কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা!
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মোহাররমের চাঁদ।...”
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন