রাজধানী ঢাকা ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের মধ্যে দূষিত বায়ুর শহর হিসাবে ঢাকা শীর্ষ সারিতে রয়েছে। এবার উষ্ণতার কারণে বিশ্বের শীর্ষ চরম তাপমাত্রার শহরের তালিকায় উঠে এসেছে। এই চরম উষ্ণতার কারণে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। এ ছাড়া স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের নতুন প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। একই কারণে ঢাকার মানুষের মধ্যে বিষাদ ও উদ্বেগ বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা এখন বিশ্বের শীর্ষ দূষিততম নদীর শহর হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। ঢাকার চার পাশে যে নদীগুলো রয়েছে, যেমন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এসব বিশ্বের শীর্ষতম দূষিত নদীর মধ্যে অন্যতম। এর ফলে রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত কোটি কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ দূষণের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী যানজটের ভোগান্তিতো দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব বিচারে রাজধানী ঢাকা আর বসবাসের যোগ্য থাকছে না।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, নদীদূষণ, বায়ুদূষণ, যনজট, জলাবদ্ধতা এসব বিচারে ঢাকার বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা এবং তার বিপরীতে বসবাসযোগ্য জমির পরিমাণের অনুপাত কম হওয়ায়, একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হলে এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সবচেয়ে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তা না হলে যত পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, তা কার্যকর করা সম্ভব নয়। নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হলে, শহরকে যানজট-জলজটমুক্ত করতে হলে, বায়ুদূষণ রোধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
চলতি বছর জুনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে শেষ দিক থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৪০টি শহরের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে ১৩৭ নম্বরে রয়েছে ঢাকা। অর্থাৎ বসবাস অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৩ নম্বরে। বাস করার সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার পরে রয়েছে মাত্র দুটি শহর। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক এবং অপরটি নাইজেরিয়ার লাগোস।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক যৌথভাবে এক গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকাকে শীর্ষ চরম তাপমাত্রার শহর হিসাবে উল্লেখ করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে শহরগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে। এ দুটির প্রভাবে মারাত্মক হয়ে উঠছে সেখানকার তাপমাত্রা। এই চরম উষ্ণতার কারণে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। চরম উষ্ণতার কারণে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষকরা দেখেছেন, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোতে বসবাসরত দরিদ্র মানুষ নাগরিক সুবিধার অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। গবেষকরা ১৯৮৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর বিশ্বের ১৩ হাজার শহরে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যেসব শহরে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর থাকে, তাদেরই চরম তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, পৃথিবীর দূষিততম নদীগুলোর অবস্থান এখন নদীমাতৃক বাংলাদেশে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলীসহ অসংখ্য নদী তীরবর্তী মানুষ, প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য নদীদূষণের শিকার। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ দূষণের শিকার। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার আশপাশের চারটি নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এখন সবচেয়ে দূষিত নদী। এর ফলে ঢাকাবাসী প্রতিনিয়ত দূষণের শিকার হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে রাজধানীর জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। একই কারণে দেশের মানুষের মধ্যে বিষাদ ও উদ্বেগ বাড়ছে।
গত ৭ অক্টোবর এক ওয়েবিনারে বিশ্বব্যাংক তাদের ‘জলবায়ুর দুর্ভোগ’ বা ‘ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শিরোনামে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে এত বৃষ্টি এর আগের ৪৫ বছরে হয়নি। তারপরের মাসগুলোতে বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়া ডেঙ্গুর বাহক মশার বংশবিস্তারে সহায়ক ছিল। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় ১৯০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আবহাওয়া, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি তারা ২০১৯ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের শহর ও গ্রাম এলাকার ৩ হাজার ৬০০ খানার ওপর জরিপ করেছে।
যানজটের কারণে প্রতিদিনই চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রাজধানীবাসী। তার উপর সামন্য বৃষ্টি হলে তো যানজট আর পানিবদ্ধতায় রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ চরম পর্যায় পৌঁছে। প্রতিদিনই রাজধানীর প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সকাল থেকে তীব্র যানজটে কর্মমুখী মানুষের অবস্থা নাজেহাল। সকাল থেকে রাত অবধি রাস্তায় যেন তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এক জায়গাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায় যাত্রীদের। মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, উত্তরা, শাহবাগ, ফার্মগেট, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, মগবাজার, আজিমপুর, কমলাপুর, খিলগাঁও, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ সবখানেই প্রতিদিন তীব্র যাটজটের চিত্র দেখা যায়।
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে থাকেন বেসরকারি একটি ব্যংকের কর্মকর্তা ইশরাত সুলতানা। তিনি বলেন, মিরপুর থেকে তার কর্মস্থল মৌচাকে যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাকে। তার মতে, ঢাকা শহরে বসবাসের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে যানজট। পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি বলেন, বাসের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা নেই, ভাড়া নিয়ে কোন শৃঙ্খলা নেই, যাত্রী তোলা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে চালকদের মধ্যে, দক্ষ চালকও নেই, সবখানে এক অরাজকতা। আর এসব দেখারও যেন কেউ নেই। আসলে ধীরে ধীরে এই ঢাকা নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন