রাজধানীতে অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা মন্ত্রী-এমপি ও সচিবের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করে আসছিল। গ্রেফতারকৃতরা হলো আব্দুল কাদের মাঝি ওরফে চৌধুরী সাহেব, স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া এবং দুই সহযোগী শহিদুল আলম ও আনিসুর রহমান।
গতকাল শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন এসব তথ্য জানান ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। প্রতারকদের কারওয়ান বাজার, মিরপুর ও গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। চক্রের প্রধান আব্দুল কাদেরের পড়ালেখা দশম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে গাড়িতে স্টিকারসহ ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেকে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পরিচয় দিত।
গুলশানে জব্বার টাওয়ারে ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় রয়েছে আব্দুল কাদেরের। এছাড়া কারওয়ান বাজারে রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। বসবাস মিরপুর ৬ নম্বর সেক্টরে। একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে গুলশান ও মিরপুরে। গাজীপুরে নয় তলা বাড়ি ও গাজীপুরের পূবাইলে একটি বাগান বাড়ি রয়েছে। ঢাকায় আব্দুল কাদের অতিরিক্ত সচিব সেজে কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িতে চড়েন।
গাড়ির সামনে-পেছনে কাঁচে লাগানো সচিবালয়ের স্টিকার এবং ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। প্রতারণা ছাড়া তার বৈধ কোনো আয় নেই। বিভিন্ন মানুষকে কোটি টাকার ব্যাংক লোন ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিল। অঢেল সম্পত্তির নেপথ্যে দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রতারণা।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন উর রশিদ বলেন, জব্বার টাওয়ারের অফিসে অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া পরিচয়দানকারী কাদেরের সাথে মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে বেশ কিছু ছবি আছে। আলোচিত সাহেদের মতোই তার বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব প্রতারণার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, আব্দুল কাদেরের মিরপুরের বাসা থেকে মন্ত্রণালয়ের স্টিকারযুক্ত প্রাডো গাড়ি ও অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড, অবৈধ বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও এক রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। ডাচ বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মোটা অঙ্কের টাকাও রয়েছে।
তিনি বলেন, ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, গানম্যান ছাড়াই নিজেই অস্ত্র এবং ওয়াকি টকি নিয়ে চলাফেরা করে। তার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মটর্স ইত্যাদি।
প্রতারক কাদেরের সবচেয়ে বড় প্রতারণা হচ্ছে হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে ২০০৪-২০০৬ সালে শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি এবং খামার তৈরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটির বেশি টাকার লোন পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল।
সম্ভাব্য মক্কেলদের কাছ থেকে প্রথমেই প্রতারক আব্দুল কাদের ৫০ হাজার টাকা কনসালটেন্সি ফি নিয়ে নিত। প্রোফাইল বানানোর জন্য নিত দুই থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০ কোটির বেশি অঙ্কের লোন পাইয়ে দিতে ডাউনপেমেন্ট হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে টাকা মক্কেলদের কাছ থেকে নিত।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছে বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কাদের। সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করত। তাছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে দিতো যেগুলো দিয়ে আবার প্রতারণা করত।
প্রতারণা করতে আব্দুল কাদের নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচয় দিত। সচিবসহ ৩৩ জন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে তার কনসোর্টিয়াম, ব্যবসা আছে ইত্যাদি প্রচার করত। নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগপ্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে দাবি করে। এ পরিচয় দিয়ে টাকা আদায় করা কোনো ব্যাপার না বলে চাকরিপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণা করত।
আব্দুল কাদের ও তার স্ত্রী এবং সঙ্গীদের নামে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণা, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলা দায়ের হয়েছিল। গ্রেফতার চার আসামি রিমান্ডে রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলেও জানান অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন