ব্রুনাই শ্রমবাজারে দিন দিন দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। বৈশ্বিক করোনার মাঝে মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে দেশটির জঙ্গল এলাকায় পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাচ্ছে শত শত বাংলাদেশি যুবক। মানবপাচারকারী চক্রের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারির লকডাউনের মাঝেও দেশটিতে বর্তমানে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রুনাইতে ৭৫ হাজার ৪৩৩ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। চলমান লকডাউন তুলে নিলে দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। গতকাল শনিবার নেগারা ব্রুনাই দারুসসালাম থেকে নূরশামিয়াহ এসডিএন বিএইচডি’র ম্যানেজার আব্দুল সাত্তার এতথ্য জানান। গতকাল শনিবার দেশটিতে দু’শতাধিক ব্যক্তি করোনা শনাক্ত হয়েছে। গতকাল করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী মারা গেছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা গতকাল ব্রুনাই থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মানবপাচাকারী দালালচক্র ব্রুনাইতে বেশি বেতনে ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে জনপ্রতি সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশটির বিমান বন্দরে পৌঁছার সাথে সাথে পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রতারণার শিকার বিপুলসংখ্যক প্রবাসী কর্মী মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো সহায়তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রুনাইয়ের রাজধানী দারুসসালাম থেকে একাধিক ভুক্তভোগি এতথ্য জানিয়েছে।
মানবপাচারকারী জসিমের বিরুদ্ধে রাজবাড়ী জেলার কালুখালী থানায় প্রতারণার শিকার প্রবাসী কর্মীর অভিভাবকরা মামলা দায়ের করতে গেলে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নাজমূল হাসান মামলা নেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল শনিবার রাতে অফিসার ইনচার্জ নাজমুল হাসান ইনকিলাবকে বলেন, ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আইজিপি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অভিযোগ পাওয়া গেলে মানবপাচারকারী জসিমের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো মানবপাচারকারীর সাথে আপোসের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, যে কোনো অপরাধীই হোকনা কেন, কারোর প্রতি দয়ার দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ নেই।
প্রতারণার শিকার এসব যুবকদের পাসপোর্ট মানবপাচাকারীরা কেঁড়ে নেয়ায় তারা করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব যুবক জনবহুল এলাকায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। কেউ কেউ কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হলেও হাসপাতালে সুচিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে না।
ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানায়, রাজবাড়ী জেলার কালুখালি থানার পশ্চিম হারওয়া গ্রামের মো. আফজাল শেখের ছেলে জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেল ২০১৭ সালের মাঝামাঝি মাদারিপুরের শিবপুর থানার হযরত আলী বেপারী কান্দি গ্রামের রব মজুমদারের ছেলে প্রতারক জসিমের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দিয়ে ব্রুনাই যায়। প্রতারক জসিম হাইকমিশনের ভিসা সত্যায়ন ও বিএমইটির বৈধ বহির্গমন কার্ড ব্যতীরেকে ঢাকা বিমান বন্দর দিয়ে বডি কন্ট্রাক্ট করে ভুয়া স্মার্ট কার্ড দিয়ে জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেলকে ব্রুনাইতে পাচার করে নিয়ে যায়।
অভিযুক্ত জসিমের পরিচালনাধীন ব্রুনাইয়ের রিয়ান এসডিএন বিএইচডি নামক কথিত কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে উল্লেখিত দু’সহোদরকে ব্রুনাই নিয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছার পর জসিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাইমউদ্দিন তাদেরকে জসিমের লেবার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সাথেই তাদের পাসপোর্ট কেঁড়ে নেয়। কাজ না দিয়ে ফ্রি ভিসার কর্মী বলে তাদের রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। ভুক্তভোগী জুয়েল শেখ অভিযুক্ত জসিমকে মাসিক ৫০ ব্রুনাই ডলার করে কমিশন দিতে সম্মত না হওয়ায় জসিম জুয়েলের ভিসা নবায়ন করেনি।
গত দু’বছর যাবত জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেল দেশটিতে অবৈধভাবে অনাহার-অনিদ্রায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের কোনো ভিসা ও পাসপোর্ট না থাকায় তারা করোনা দুর্যোগকালে করোনা টিকা গ্রহণ বা কোনো চিকিৎসা সুবিধা নিতে পারছে না। প্রতারক জসিম তাদের দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশে ধরিয়ে দেযার ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মাসিক কমিশন বাবদ ৬০০ ব্রুনাই ডলার এবং রি-এন্টির খরচ বাবদ ২ হাজার ২০০ ব্রুনাই ডলার ও ইন্স্যুরেন্সের নামে ১২০ ব্রুনাই ডলার হাতিয়ে নেয়। যা ব্রুনাইয়ের শ্রম আইন ২০০৯ অনুযায়ী অবৈধ।
ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা গত ২৩ সেপ্টেম্বর মানবপাচারকারী জসিমের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি, সিআইডি, সিআইডি হেডকোয়াটার্স বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করেছেন। প্রতারক জসিম ইমামুল হোসেন সোহাগ নামের বাংলাদেশি যুবককে তুরস্ক পাচার করেছে বলেও হাইকমিশনের লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
ব্রুনাই হাইকমিশনের লেবার কাউন্সেলর জিলাল গতকাল ইনকিলাবকে জানান, জসিমের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সোহাগ বর্তমানে সার্বিয়ার জেলে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এছাড়া বিবাড়িয়ার দালাল রফিকের প্রতারণার শিকার ইসরাফিল ব্রুনাইতে পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণার শিকার চাঁদপুরের আব্দুল মালেক ব্রুনাইয়ের জঙ্গল এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে হাইকমিশন কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, লকডাউনের মাঝে হাইকমিশন প্রবাসীদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন