হাতের লেখা পাসপোর্ট থেকে মেশিন রিডেবল। ম্যানুয়াল থেকে এমআরপি। এমআরপি’র পর এখন চলছে ‘ই-পাসপোর্ট’। পাসপোর্টের ধরন বদলালেও পরিবর্তন আসে না মানুষের দুর্ভোগে। পরিবর্তন হয় না পাসপোর্ট সংশ্লিষ্টদের ঘুষ-বাণিজ্যেরও। যেখানে যে অবস্থায় থাকেন-অব্যাহত থাকে তাদের ঘুষ-বাণিজ্য। দু’হাতে যেমন হাতিয়ে নেন তেমনি দু’হাতে অকাতরে ছড়ান যেখানে যতটা লাগে। ঘুষের টাকা আদায় এবং উপরস্থ কর্মকর্তাদের ‘তুষ্ট’ করে হয় বিশ্বস্ত ‘চ্যানেল মাস্টার’। পাসপোর্টের দুর্নীতির সাংকেতিক নাম এটি। চ্যানেল মাস্টারের মাধ্যমে কোথা থেকে কত টাকা ঘুষ পেতেন এবং পদস্থ কর্মকর্তাদের কাকে কত দিতেন-তারই অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন পাসপোর্টের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মো. তৌফিকুল ইসলাম খান।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার স্বীকারোক্তি ধরে মিলিয়ে নিচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে তৌফিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের। এছাড়া ২১টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট ভবন নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতিও উদ্ঘাটিত হয়েছে। এসবসহ দুদক পৃথকভাবে আরও অন্তত: ৫টি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দুদক কি করছে না করছে সেই আপডেট আমার জানা নেই। ওটা দুদককেই জিজ্ঞেস করুন। তবে দুদকের উপ-পরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, পাসপোর্টের দুর্নীতি নিয়ে আরও ৪/৫টি মামলার প্রস্তুতি চলছে। গত দুই মাসে পাসপোর্টের ৩ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা করে দুদক।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেয়া স্বীকারোক্তি মতে, চাকরিতে যোগদান করেই ‘উপুরি আয়’র দিকে চোখ পড়ে পাসপোর্ট পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খানের। ২০০৪ সালে যশোর আঞ্চলিক অফিসে প্রথম যোগদান। প্রথম মাসেই ৫ হাজার টাকা করে পেতেন। পরবর্তী মাসে প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ‘উপুরি আয়’ করতেন তিনি। পোস্টিংয়ের প্রথম ২ মাসের মাথায় বদলি হয়ে আসেন ঢাকাস্থ সাভার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। এখানে সপ্তাহে উপুরি আয় করেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ২০০৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেড় বছর ছিলেন পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে। এখানে সপ্তাহে পেতেন ৩-৪ লাখ টাকা। প্রাপ্ত টাকা থেকে উপরস্থ অফিসারদের সপ্তাহে বখরা দিতেন ২ লাখ টাকা করে।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম ৪ মাস ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১ লাখ টাকা করে অধীনস্থ অন্য অফিস থেকে পেতেন। প্রধান কার্যালয় থেকে তৌফিককে পোস্টিং দেয়া হয় নোয়াখালি পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে দেড় বছর ঘুষ নেয়া বন্ধ ছিল। শেষের দিকে সপ্তাহে ২-৩ লাখ টাকা করে পাওয়া শুরু করেন। এ সময় উপরস্থ কর্মকর্তাদের মাসে ২-৩ লাখ টাকা করে বখরা দিতেন। সেখান থেকে বদলি হন কুমিল্লা। এখানকার ৮০ ভাগ পাসপোর্টের আবেদনই জমা পড়তো দালালের মাধ্যমে। অফিস খরচ এবং হেড অফিসের খরচ বাদ দিয়েই তৌফিক আবেদনপ্রতি ৪৮ % টাকা এককভাবে পেতেন। উপ-সহকারী পরিচালকদের ২ % হারে ছাড় দিতেন। প্রথম ৪ মাস সেখানে সপ্তাহে ৪-৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নিতেন। উপরস্থ অফিসারদের দিতেন সাড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে। প্রধান কার্যালয়ের সিদ্দিক, রফিকুল ইসলাম (মরহুম), নজরুল ইসলাম (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে), পারভীন এবং রফিকউদ্দিনকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হতো।
২০০৯ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ছিলেন গোপালগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। সেখান থেকেও ঘুষ নিতেন পাসপোর্টের এই কর্মকর্তা। সপ্তাহে পেতেন ৫০-৬০ হাজার টাকা। প্রধান কার্যালয়ে মাসোহারা দিতেন ৩০-৪০ হাজার টাকা করে। গোপালগঞ্জ থেকে বদলি হন সিলেটে। ওখানে ছিলেন টানা ৩ বছর। সপ্তাহে পেতেন ৩-৪ লাখ টাকা করে। হেড অফিসকে দিতেন মাসে ২ লাখ টাকা করে। হাতে লেখা পাসপোর্ট চালু থাকতে আবেদন প্রতি ৫শ’ টাকার বেশি নিতে পারতেন না তৌফিক। ২০১৩ সালে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) চালু হয়।
ওই বছরই তিনি উপ-পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। তার পোস্টিং হয় যাত্রাবাড়ি কার্যালয়ে। এমআরপি হলেও পাসপোর্ট অফিসগুলোতে ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ কমেনি। বেড়ে যায় তৌফিকের ঘুষের রেটও। এ সময় ফাইল প্রতি ৮শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতেন। এখানে প্রথম ৪ মাস সপ্তাহে ৪০-৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ পেতেন। সেখান থেকে হেড অফিসেও কিছু দিতেন। পরবর্তীতে বদলি হয় কুমিল্লা। ছিলেন টানা ২ বছর। এ সময় সপ্তাহে গড়ে ১৬ লাখ টাকা করে পেতেন। হেড অফিসে অতিরিক্ত মহা-পরিচালক রফিকুল ইসলামকে দিতেন মাসে ৮-১০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে ঘুষের বিনিময়ে আবারও চলে আসেন হেড অফিসে।
চ্যানেল মাস্টারদের ‘চেইন অব কমান্ড’ : ঘুষ বাণিজ্যের সাংকেতিক পদ্ধতি এবং ‘চেইন অব কমান্ড’। গোপন তালিকাভুক্ত দালালরা পাসপোর্ট আবেদনকারীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফরম ফিলআপ করেন। অন্যান্য কাজ সম্পাদন করে ফরমে একটি বিশেষ চিহ্ন দিয়ে জমা করে। চিহ্নসম্বলিত ফরম দ্রুত জমা নেন পাসপোর্ট কর্মকর্তারা। দিন শেষে চিহ্নযুক্ত ফরমগুলো আলাদা করা হয়। একেকটি চিহ্ন একেকজন অফিস কর্মচারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নিজ নিজ ফাইলের গতিবিধির ওপর খেয়াল রাখেন পাসপোর্ট কর্মচারীরা। নিজ নিজ চিহ্নের আবেদন একজন নির্দিষ্ট কর্মচারীর কাছে টাকার অঙ্কের হিসাবসহ জমা হয়। তাদেরকে ‘ক্যাশিয়ার’ এবং ‘চ্যানেল মাস্টার’ বলা হয়।
সপ্তাহের শেষ দিকে ক্যাশিয়ার চ্যানেল মাস্টারের কাছে হিসাব ‘ক্লোজড’ করেন। অর্থাৎ দালাল ওই সপ্তাহে যে ক’টা ফাইল জমা করেছে তার টাকা (৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা করে), তার ফাইল যে কর্মচারীকে দেয় ওই কর্মচারী ক্ষেত্র বিশেষে নিজে ৫০-১০০ টাকা করে রেখে বাকি টাকা ক্যাশিয়ারের কাছে জমা করেন। ক্যাশিয়ার সবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে একত্রিত করেন। সংগ্রহকৃত সপ্তাহের টাকা থেকে অফিস খরচ ও হেড অফিসের জন্য কিছু টাকা আলাদা করেন। পুরো টাকা নির্দিষ্ট হারে অফিস প্রধান ও কর্মচারীদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। এ টাকার অর্ধেক অফিসপ্রদান এককভাবেই নিয়ে নেন। হেড অফিসের টাকাও অফিস প্রধানকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়।
প্রতি সপ্তাহে সংগৃহিত ঘুষের টাকা কোনো ব্যাংকে জমা হয় না। অফিসপ্রধান হেড অফিসের টাকা প্রথমে উপরস্থ কর্মকর্তার নাম লিখে আলাদা অনেকগুলো খামে ভরেন। খামগুলো পরে বড় আরেকটা খামে ঢোকান। এই খাম কখনও বিশেষ বাহক মারফত তৎক্ষণাৎ হেড অফিসে পাঠাতেন। কখনও বা ঢাকায় এসে সরাসরি নিজ হাতে দিতেন। হেড অফিসের উপরস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকার রিকুইজিশন থাকলে আঞ্চলিক অফিস থেকে আলাদা টাকা ওঠানো হতো। সেই টাকা বিশেষ বাহক মারফত পাঠানো হতো ঢাকায়। অন্য আঞ্চলিক অফিস প্রধানদের কেউ কেউ বড় কর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টাকা হস্তান্তর করেন। বড়কর্তার সাক্ষাৎ না পেলে হেড অফিসের বিপুল, আজিম এবং মাসুদ রানার কাছে খাম রেখে যান।
তৌফিক আঞ্চলিক অফিসের কার্যপ্রধান থাকা অবস্থায় ময়মনসিংহে গিয়ে মেহেদীর কাছ থেকে নিয়েছে ৭-৮ লাখ টাকা করে। কুমিল্লা থেকে পেয়েছেন মাসে ৪ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের মনসুরাবাদে ৫০ হাজার টাকা করে দিতো। কিন্তু তৌফিক এই হার বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করেন। চাঁদগাঁও অফিসে আল-আমীনের সময় ৫০ হাজার টাকা করে উঠতো। তৌফিক পেতেন ১ লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আল-আমীনের সময় ৫০ হাজার উঠতো। রেট বাড়িয়ে তৌফিক নিতেন ১ লাখ। নোয়াখালিতে নূরুল হুদার সময় ছিল ৫০ হাজার। তৌফিক নেন ১ লাখ টাকা করে। নারায়ণগঞ্জের মাকসুদ দিতেন ১ লাখ টাকা করে। গাজীপুর থেকে পেতেন ৫০ হাজার। মুন্সিগঞ্জের হালিমার কাছ থেকে সর্বশেষ ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। যশোর থেকে ৫০ হাজার টাকা। রাজশাহী অফিস থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা সরাসরি বাড়ি পাঠানো হতো। চাঁদপুর, লক্ষèীপু, সিরাজগঞ্জ অফিস ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে পেতেন।
তবে কক্সবাজার,পার্বত্য ৩ জেলা, ঢাকার উত্তরা, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, বগুড়া, ফিরোজপুর, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, ঠাকুর গাঁও, নিলফামারী, জয়পুর হাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ নাটোর অফিস থেকে তৌফিক কোনো টাকা পেতেন না। মেহেরপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, রংপুর থেকে টাকা পেতেন মাঝেমধ্যে। দিনাজপুর থেকে পেতেন ২০ হাজার টাকা করে। রাজশাহীর হাফিজ দিতেন ২৫ হাজার টাকা। যাত্রাবাড়ি থেকে আসতো ৩০ হাজার টাকা করে।
প্রসঙ্গত: এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশিত ‘কত সম্পদ পাসপোর্ট পরিচালক তৌফিকের’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই প্রতিবেদনে পাসপোর্ট পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মো. তৌফিকুল ইসলাম খানের সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। তার ঘুষ-বাণিজ্য সিন্ডিকেটভুক্ত সদস্যদের বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। যা দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে গতি সঞ্চার করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন