মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

রহমতে আলম (সা.) আগমনের সুসংবাদ

মুফতি মুহাম্মাদ আকতার আল-হুসাইন | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার জমিনে মানুষ জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। কুরআন শরীফের সূরা আয-যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- জ্বিন ও মানুষকে আমি আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি”। আবার এই মানুষ জাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করে জান্নাতের পথে নিয়ে যাওয়া এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নাবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। এক লক্ষ মতান্তরে দু লক্ষ চব্বিশ হাজার নাবী রাসূল এসেছিলেন। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নাবী হিসেবে আগমন করেছিলেন আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফের সূরা সাবার ২৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন- আমি তো আপনাকে সব মানুষের জন্য সু-সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশ্বজনীন রাসূল হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন যে, তাঁকে সকল মানুষের হিদায়াতকারী ও পথপ্রদর্শকরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বজনীন রাসূল হওয়ার ব্যাপারে সূরা আরাফের ১৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- আপনি বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তায়ালা সূরা ফুরকানের শুরুতেই বলেছেন- কত প্রাচুর্যময় তিনি যিঁনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। যাতে তিঁনি বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন।

শেষ নাবীর স্বীকৃতি দিয়ে সূরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন (তার কোন বয়স্ক ছেলে নেই)। বরং তিঁনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নাবী। আল্লাহ সবকিছুই ভালভাবে জানেন। এখানে শেষ বলতে মোহরকে বলা হয়েছে। আর মোহর সর্বশেষ কর্মকে বলা হয়। যেমন, পত্রের শেষে মোহর মারা হয়। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনে নবুয়াত ও রিসালাতের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পর যে কেউ নাবী হওয়ার দাবী করবে, সে নাবী নয়, বরং মিথ্যুক ও দাজ্জাল বলে পরিগণিত হবে। উক্ত বিষয়ে হাদীস গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাতে সকল উম্মত একমত। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে হযরত ঈসা (আ.) এর অবতরণ হবে, যা সহীহ ও সূত্রবহুল প্রসিদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। তবে তিনি নাবী হয়ে আসবেন না, বরং শেষ নাবীর তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত হয়ে আসবেন। যার ফলে তাঁর অবতরণ হওয়া খাতমে নাবুয়াত এর আক্বীদার পরিপন্থী নয়।

কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন আমাদের কল্যাণের জন্য। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের মাস পবিত্র রবিউল আউয়ালকে সামনে রেখে তাঁর আগমনের সু-সংবাদ আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি শরীয়ত যেভাবে সমর্থন করে। এ বিষয়ে কুরআন, হাদীস ও সিরাতের কিতাবে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন-
আল্লাহ তায়ালা নিজেই সু-সংবাদ দিয়েছিলেন : সূরা আল-ইমরানের ৮১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ নাবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এই বলে- আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করেছি তা গ্রহণ কর। অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থক একজন রাসূল আসবেন। তখন অবশ্যই তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিঁনি বলেছিলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ ব্যাপারে আমার চুক্তি গ্রহণ করলে? তারা বলেছিলেন, স্বীকার করলাম। তিঁনি বলেছিলেন, তাহলে তোমরা সাক্ষী থেকো, আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে তাবরানীর মধ্যে এসেছে- হযরত আলী (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা সব রাসূলগণের কাছ থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অঙ্গীকার নেন যে, তারা স্বয়ং যদি তাঁর আমলে জীবিত থাকেন, তবে যেন তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন তথা ঈমান আনেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন। স্বীয় উম্মতকেও যেন এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে যান সুতরাং এই আয়াতে কারীমা থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝলাম যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রুহ জগতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের সু-সংবাদ দিয়েছিলেন। তাও আবার সমস্ত নাবী রাসূলদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে যে, শেষ নাবীর সাক্ষাত পেলে উনার প্রতি ঈমান আনতে ও ইসলাম প্রচারে সাহায্য করতে।

হযরত আদম (আ.) সংবাদ দিয়েছিলেন : হযরত আদম (আ.) উনার পুত্র শীস (আ.) কে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। আর সেই সময় তিঁনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম মোবারক নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেগুলো সিরাতের বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। এরকম একটি বর্ণনা জুরকানীতে এসেছে- হযরত আদম (আ.) আপন পুত্র শীস (আ.) কে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার ছেলে! আমার পরে তুমি খলিফা হবে। সুতরাং খলিফা হওয়ার পরে খেলাফতকে তাক্বওয়ার তাজ ও দৃঢ় একিনের মাধ্যমে মজবুত করে আকঢ়ে রাখবে। আর যখন আল্লাহর নাম নিবে তখন সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম নিবে। তার কারণ হলো আমি যখন রূহ আর মাটির মধ্যে ছিলাম তখন এই পবিত্র নাম আরশের পায়ায় আল্লাহর নামের সাথে লিখিত দেখেছি। এরপর আমি সমস্ত আকাশ ভ্রমণ করেছি, তখন আকাশের কোন একটি স্থান পাইনি যেখানে এই পবিত্র নাম লেখা নেই। আমার রব আমাকে জান্নাতে দিলেন, তখন জান্নাতের এমন কোন প্রসাদ বা কামরা পাইনি যেখানে এই পবিত্র নাম লেখা নেই। আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নাম লেখা দেখেছি হুরদের কপালে, জান্নাতের সমস্ত গাছের পাতায়, বিশেষ করে তুবা ও সিদরাতুল মুনতাহা নামক গাছের পাতায় পাতায়, পর্দার কিনারায় এবং ফেরেস্তাদের চোখের মনিতে এই পবিত্র নাম লেখা দেখেছি। সুতরাং হে আমার ছেলে! তুমি এই পবিত্র নাম বেশি বেশি জপতে থাক। কেননা ফেরেস্তাগন আগ থেকেই এই পবিত্র নাম জপনে মশগুল আছেন।

হযরত ইব্রাহীম (আ.) দোয়া করেছিলেন : হযরত ইব্রাহীম (আ.) শেষ নাবীর আগমনের জন্য আল্লাহর দরবারে যে দোয়া করেছিলেন তা কুরআন শরীফের সূরা বাকারার ১২৯ নম্বর আয়াতে এসেছে- হে আমাদের প্রভু! আর তুমি তাদের মধ্যে তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ তথা কুরআন শরীফ পাঠ করে শোনাবেন। এবং তাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন, আর তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। তুমিই তো মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। উক্ত আয়াতে কারীমা থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝলাম যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন আমাদের নাবীর আগমনের জন্য, আর সেই দোয়ার জবাব আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফের সূরা আল-ইমরানের ১৬৪ নম্বর আয়াতে দিয়ে বলেছেন- আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিঁনি তাদের নিজেদের থেকেই তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ তথা কুরআন শরীফ পাঠ করে শোনান, তাদেরকে পরিশোধন করেন ও কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলো।

তাওরাত ও ইঞ্জিলে সু-সংবাদ প্রদান : পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের সু-সংবাদ প্রদান করা হয়েছিলো। কুরআন শরীফের সূরা আশ-শু’আরার ১৬৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন - পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহে (তাওরাত ও ইঞ্জিল) এর উল্লেখ রয়েছে তাফসীরে ইবনে কাসিরের মধ্যে আছে- হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) এর সাথে সাক্ষাত করে আরয করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে সকল গুন তাওরাতে উল্লেখ আছে, তা আমাকে বলে দিন। তখন তিনি আমাকে বললেন, হাঁ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কুরআন শরীফে যে সকল গুণাবলি দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে, এরকম অনেক গুন দিয়ে তাওরাতেও ডাকা হয়েছে। যেমন- হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি একজন সাক্ষী, সু-সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে।

কুরআন শরীফে যেমন শেষ নাবীর আগমন বার্তা ও তাঁর সুন্দর চারিত্রিক গুণাবলীর বর্ণনা পূর্বের ধর্মগ্রন্থসমূহে রয়েছে। অনুরূপ কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সু-সংবাদ ও তাঁর সাহাবীদের পরিচিতি ও দেওয়া হয়েছে। আর এই কথাগুলো আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা ফাতাহ এর ২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করেছেন- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্ট কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদার প্রভাবের চিহ্ন পরিস্ফুট থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা হল যেমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং কান্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Monjur Rashed ১৮ অক্টোবর, ২০২১, ১২:১৯ পিএম says : 0
Subhan Allah.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন