নির্মাণকালে গার্ডার ধসে ১৪ জনের প্রাণহানির ঘটনায় আলোচিত সেই বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে এবার ফাটল দেখা দিয়েছে। বহদ্দারহাট মোড়ে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকামুখী র্যাম্প বরাবর দুটি পিলারে বড় ফাটল ধরেছে। একইসাথে র্যাম্পের একাংশে ফাটল দেখা গেছে। এ অবস্থায় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সোমবার রাত ১১টা থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। এতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে পুরো এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রকৌশলীরা বলছেন, নকশায় গলদ এবং নির্মাণ ত্রুটির কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় সোয়াশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভার চালুর আট বছরের মাথায় ফাটল দেখা দিল। ফ্লাইওভার পরিদর্শন করে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী সিডিএকে দোষারোপ করে নির্মাণ ত্রুটির কারণে ফ্লাইওভারটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তবে সিডিএর কর্মকর্তারা দাবি করেন, নকশা কিংবা নির্মাণ ত্রুটি ছিল না। ধারণক্ষমতার বেশি ওজনের যানবাহন চলাচল করায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ফ্লাইওভারে ফাটল দেখা দেয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রাতেই আশপাশের দোকান-পাট সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন তারা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতা ও স্থপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, এটি নিশ্চিত করে বলা যায় নকশায় গলদ এবং নির্মাণ ত্রুটি তথা নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ফ্লাইওভারে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে এটি মেরামত করারও সুযোগ রয়েছে। এটি আদৌ টেকসই কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এর পাশাপাশি যারা সরকারি টাকা অপচয় করে নিম্নমানের স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। কারণ এ টাকা জনগণের। জনগণের টাকায় নির্মিত অপরিকল্পিত এ ফ্লাইওভার এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ফ্লাইওভার মেরামত ও সংস্কার ব্যয়বহুল বলেও জানান তিনি।
কোনরকম প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই মাস্টারপ্ল্যানের বাইরে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার প্রকল্পটি নেন সিডিএর ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্বঘোষিত কর্মবীর আবদুচ ছালাম। শুরুতে বহদ্দারহাট মোড় থেকে একসাথে পাঁচটি ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদদের আপত্তির মুখে বহদ্দারহাট থেকে চান্দগাঁও থানার নিকটবর্তী এক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ফ্লাইওভারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণকাজ চলাকালে ২০১২ সালের নভেম্বরে গার্ডার ধসে ১৪ জন নিহত হন। এর আগে আরেক দফায় গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। গার্ডার ধসে ১৪ জনের প্রাণহানি এবং বেশ কয়েকজন মানুষ পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ফ্লাইওভারটি বাকি কাজ এগিয়ে নেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। নাম দেয়া হয় এম এ মান্নান ফ্লাইওভার।
যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর দেখা যায় ফ্লাইওভারে যানবাহন নেই। আগের মতই বহদ্দারহাট এলাকায় তীব্র যানজট। এ প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বহদ্দারহাট মোড় থেকে কালুরঘাটমুখী সড়কে র্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সকে দিয়ে এ কাজ করানো হয়। চার বছর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৩২৬ মিটার দীর্ঘ ও ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র্যাম্পটি নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য ফ্লাইওভারটি খুলে দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সিডিএ বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারসহ নগরীর তিনটি ফ্লাইওভার ও একটি ওভারপাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। নগরীর বহদ্দারহাট থেকে সিএন্ডবি হয়ে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কের পাশেই কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা, বাস টার্মিনাল ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা। কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকার কারখানাগুলোর পণ্যবাহী যানবাহন এই র্যাম্পের ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার হয়ে চলাচল করে। ফাটলের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় পুরো এলাকায় তীব্র যানজট শুরু হয়েছে।
সকালে ফ্লাইওভার পরিদর্শনে যান সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিকসহ প্রকৌশলীরা তার সাথে ছিলেন। র্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দেয়ার ঘটনায় অবাক হয়েছেন জানিয়ে মেয়র বলেন, এতে যেকোনো সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কারণ, এই ফ্লাইওভারটি আগেও একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। নিশ্চয়ই নির্মাণে ত্রুটি আছে। যার ফলে এ ফাটল দেখা দিয়েছে।
কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, দুটি কারণে ফাটল দেখা দিতে পারে। একটি নকশাগত ত্রুটি, অন্যটি নির্মাণ ত্রুটি। তবে ঠিক কী কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে ওভারলোডের গাড়ি চলাচলের কারণে এটা হতে পারে। নির্মাণকাজে যুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, র্যাম্প মূল নকশায় ছিল না। পরে যুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য নকশায় ত্রুটি থাকতে পারে। এটি সিডিএ নির্মাণ করেছে। সমস্যার সমাধানে তারাই ব্যবস্থা নেবে। কী পরিমাণ লোড নিতে পারবে, সেটা তারাই হিসাব করে এটি নির্মাণ করেছে। গাড়ি চলাচল না থাকায় ফাটল বড় হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর নিচে চলাচল করা গাড়ির কম্পনের কারণে ফাটল বড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এদিকে র্যাম্প নির্মাণে কোনো ধরনের নকশা বা কাজের ত্রুটি ছিল না বলে দাবি করেছেন সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে ফাটল দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তা মেরামত করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন