শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাউবো থেকেও নেই, যমুনা গ্রাস করছে চরসলিমাবাদ

নদী ভাঙে, কপাল পুড়ে সখিনার

প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : নদী ভাঙে না; ভাঙে বুকের পাঁজর। কপাল পুড়ে সখিনার। স্বামীর বসতবাড়ি, দুই বিঘা আবাদী জমি, আম-কাঁঠালের বাগান সবটুকুই এখন নদীগর্ভে। কৃষিজমি বলতে আর কিছু নেই। এখন একমাত্র ছেলে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালায়।
শুধু সখিনা নয়; যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব^ হারিয়ে আমিনা, খাদিজা, সুরত বেওয়া, শিবানী, মালতীরাও এখন অসহায়। রাতারাতি পথে বসে যাওয়া এসব অসহায় পরিবারগুলো এখন ঠিকানাহীন। বাপ-দাদার চেনা ভিটামাটি হারিয়ে কার কোথায় ঠাঁই হয়েছেÑ সরকারের পরিসংখ্যানে তা নেই। জীবনের তাগিদে এদের অনেকেই এখন উদ্বাস্তু, শহরমুখী।
যমুনা নদীর ভাঙনে সিরাজগঞ্জ জেলার চর সলিমাবাদের চিত্র এটি। এখানকার নদী ভাঙনকবলিত হাহাকারের এমন চিত্র একটি-দুটি নয়, লক্ষাধিক মানুষের। এই নদীর ভাঙনে গত ৫ বছরে এখানকার মানুষের হাজার হাজার একর সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
নদী কেড়ে নিয়েছে এখানকার মানুষের বসতবাড়ী, আবাদি জমি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গোলার ধান, মুখের আহার, বেঁচে থাকার সম্বলসহ আরও কত কী।
নদী ভাঙনের শিকার এখানকার মানুষগুলোর চোখে-মুখে শুধুই আতঙ্ক। ভাঙনের আতঙ্ক, কাজ না পাওয়ার আতঙ্ক, ঘরে ক্ষুধার্ত সন্তানের আর্তনাদ, অসুস্থ পিতা-মাতার চিকিৎসা করাতে না পারা, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে বিপদগামী হওয়ার হাতছানি, একশ্রেণির টাউটের খপ্পরে পড়ে পুরো পরিবার জিম্মি হয়ে যাওয়া, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে নদী ভাঙনকবলিত এই এলাকার মানুষগুলো। এখানকার অমানবিক পরিস্থিতি না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই।
যমুনা নদীর ভাঙন থেকে এই এলাকাকে রক্ষার জন্য এখানকার অসহায় মানুষগুলো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে সরকারের দ্বারে দ্বারে ধর্না দিয়েছেন। স্থানীয় প্রতিনিধিরাও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা-তদবির করেছেন ভাঙন ঠেকাতে কোনো প্রকল্প নেয়া যায় কীনা। এজন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, এমনকি অত্র এলাকার কৃতী সন্তান হিসেবে যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন তাদের শরণাপন্নও হয়েছেন। কিন্তু হতভাগ্য মানুষগুলোর এসব দৌড়ঝাঁপে শুধুমাত্র সময়ের অপচয়ই হয়েছে; কোনো সুফল আসেনি। বরং যমুনার ভয়াল থাবায় চোখের সামনে নদীগর্ভে একের পর এক বিলীন হয়ে গেছে নিজেদের সহায়-সম্বল সবকিছু।
যমুনা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে চর সলিমাবাদ এলাকাটি এখন এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, এখানকার নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলোকে সরকারি কিম্বা ব্যক্তিগত কাজের জন্য তাদের নিজ উপজেলা চৌহালিতে যোগাযোগ করতে হলেও নৌকা কিম্বা ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এক সময় চর সলিমাবাদ থেকে সরাসরি অটোরিকশা, সিএনজি কিম্বা বাসেই চৌহালি উপজেলায় যেতে পারত এখানকার অধিবাসীরা। গত দুই বছরে নদীর গর্ভে কমপক্ষে ৫ কিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। সেই সাথে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে এখানকার সড়ক পথ।
এই এলাকার মানুষগুলোর এখন এতটাই করুণ দশা যে, উন্নত চিকিৎসার জন্যও তাদেরকে কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় ওপারে গড়ে উঠা পাবনা জেলার এনায়েতপুর হাসপাতালে; কিম্বা খানা-খন্দে ভরা বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা সদর হাসপাতালে। আর সড়ক পথে চৌহালি সদর হাসপাতালে যেতে হলে আরও অধিক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এক্ষত্রে নাগরপুর থেকে আরও ১৪ কিলোমিটার পারি দিয়ে তারপর যেতে হবে চৌহালিতে। এমন পরিস্থিতিতে এখানকার মানুষগুলো প্রতিনিয়ত কতটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টিকে আছেন-তা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সরেজমিনে যেয়ে দেখা উচিত।
নদী ভাঙনের পরও চর সলিমাবাদ এলাকায় বর্তমানে ৬৫ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৪০ হাজার ভোটারই রয়েছে। যমনার ভাঙন থেকে চৌহালী উপজেলা সদরকে রক্ষায় গত সাত বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য ব্যয় হয়েছে শত শত কোটি টাকা। বারবার কাজ করার পরও চৌহালী উপজেলা সদরে একের পর এক ভাঙন নিয়ে সেখানে আন্দোলনও হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নামে।
চৌহালির ভাঙন প্রতিরোধ কাজে অনিয়ম তদন্তে একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়েছে। কিন্তু কোনো সুফল আসেনি। এমনিতেই পাউবো’র কোনো কর্মকর্তার নামে অনিয়ম কিম্বা দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তা থেকে অনায়াসেই দায়ী ব্যক্তিটি রেহাই পেয়ে যান। তদবির কিম্বা তদন্তকারী কর্মকর্তাটি একই প্রতিষ্ঠানে তার ঊর্ধ্বতন বস হওয়ার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো কিছুই হয় না। বরং পুকুর চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও শাস্তির বদলে পদোন্নতি পেয়ে ভালো ভালো জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন এমন নজির অনেক রয়েছে। বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ও জানে। চৌহালির কাজের দুর্নীতির সাথে জড়িত একাধিক কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে।
তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে চৌহালি উপজেলাকে রক্ষায় যে কাজ চলছে তা অনেকটাই স্বচ্ছ। এই কাজের মূল অর্থ যোগানদাতা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই কাজের দেখভালের জন্য পাউবোর পাশাপাশি এডিবি’রও নিজস্ব একটি কমিটি রয়েছে। ‘ফ্লাড এন্ড রিভার ব্যাঙ্ক ইরোশন রিস্ক মেনেজম্যান্ট প্রোগ্রাম-ফেস ১’ এর আওতায় চৌহালি উপজেলা সদর রক্ষায় ১২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী ভাঙন প্রতিরোধ কাজ চলছে।
এই প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা যায়, আটাপাড়া থেকে খাসকাউলিয়া দক্ষিণ জনতা উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত ৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত এডিবি’র প্রকল্পের কাজ চলছে। আবার খাসকাউলিয়া দক্ষিণ জনতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিটুয়ানি পর্যন্ত যমুনার বুক জুড়ে চর জেগে উঠায় এই অংশে তেমন ভাঙন নেই। এরপরই বিটুয়ানি থেকে পাতরাইল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার জুড়ে চলছে ব্যাপক ভাঙন। এই সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকার নদী ভাঙন রোধে প্রকল্প নেয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী হন্যে হয়ে ঘুরছে স্থানীয় পাউবো কর্মকর্তাদের পেছনে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সমাজসেবক ও পয়লা উচ্চ বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি আনিসুর রহমান সিকদার ইনকিলাবকে বলেন, আমরা সরকারের কাছে চাল-গম চাই না। আমরা চাই দ্রুত এখানকার নদী ভাঙন রোধে কাজ করা হোক। তিনি বলেন, হাজার হাজার নদী ভাঙনকবলিত মানুষের শোকে এখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আছে। আর ৫০ থেকে ১শ’ ফুট ভাঙলে আরও অন্তত ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, খেলার মাঠ, কবরস্থান সহ অসংখ্য বসতবাড়ি, আবাদি জমি, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন