পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুবিধা যত বাড়ছে; পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ছে অপব্যবহার। দেশে প্রতিদিনই বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পজেটিভ ব্যবহারের বদলে নেগেটিভ তথা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে জালিয়াতি ও প্রতারণা, আইডি হ্যাক, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনলাইনে জুয়া খেলা ও মানব পাচারসহ নানা ধরনের সাইবার অপরাধ ঘটছে। অনেক সময় অপরাধীরা হুমকি নিয়ে ভিকটিমকে ব্ল্যাকমেইল করছে। আর সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়, এ ধরনের অপরাধে উড়তি বয়সী তরুণ-তরুণীরা বেশি জড়িয়ে পড়ছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা। এমনকি সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বয়ং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছর প্রথম ৬ মাসে ৮২৭ জন ভিকটিম শুধু সাইবার বুলিং অপরাধের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ৮ হাজার ৭৭০ জনকে অনলাইনের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছে। ডিএমপির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন ভিকটিম সাইবার সম্পর্কিত অভিযোগ মৌখিক ও লিখিতভাবে দিচ্ছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন ৪০টির মতো অভিযোগ আসলে মাসে ১২০০ অভিযোগ পড়ছে।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়া ইনকিলাবকে বলেন, আগে যে ধরনের অপরাধ ছিল সেগুলো আছে। একই সাথে অপরাধীরা নতুন নতুন কৌশলেও সাইবার অপরাধ করছে। অপরাধের ধরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাইবার বুলিং, সাইবার হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইল করা, ই-কর্মাসের মাধ্যমে প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে প্রতারণা, এমএলএম কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারণা, শিশু পর্নোগ্রাফিসহ নানা ধরনের অপরাধ বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে আমরা সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু নিয়মিতই অভিযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের পাশাপাশি এ ধরনের অপরাধী নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাবও কাজ করছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি আলাদা শাখাও হয়েছে। তারাও নিয়মিত অভিযোগ পাচ্ছে। অপরাধীদের চিহিৃত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এক কথায় প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে।
অভিভাবকদের উদ্দেশে সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি অভিভাবককেই তাদের সন্তানদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। মেয়েদের যে সাইবার বুলিং করছে; তা আমাদের আশপাশের লোকরাই করছে। সচেতনতা বাড়িয়ে এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়া যারা ভিকটিম হচ্ছেন; তাদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে; যাতে মেয়েরা অপরিচিত কারো ফাঁদে পড়ে যাতে ভিকটিম না হয়।
এদিকে, ডিএমপির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩ শতাংশ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে।
চলতি বছর শুরুর দিকে রাজ নামের ছেলের সাথে ফেসবুকে পরিচয় হয় রহিমা আক্তার (ছদ্মনাম) নামের এক তরুণীর। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। পরে শুরু হয় প্রেম। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ ৫ থেকে ৬ মাস বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরিও করেন রাজ। শুধু তাই নয়, দু’জনের মধ্যে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কও হয়। এক পর্যায়ে জুলাই মাসের দিকে ব্রেকআপ দিয়ে চলে যান রাজ। এতে ভেঙে পড়েন মার্স্টাসে পড়ুয়া ওই তরুণী। এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। উল্টো মাদক সেবনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি।
শুধু ছেলেরাই মেয়েদের সাথে প্রতারণা করেছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে উল্টো মেয়েরাই এখন ছেলেদের সাথে প্রতারণ করার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালাকপ্রাপ্ত মেয়েও উড়তি বয়সী ছেলের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে দিচ্ছেন টাকা।
সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনেক মেয়েই এ ধরনের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। প্রতিদিন অভিযোগ জমা পড়ছে তাদের কাছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেলিব্রেটি বা অভিনেত্রীরা পর্যন্ত স্ট্যাটাস দিতেও ভয় পান সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার আতঙ্কে।
পুলিশ সদর দফতরের আইনি আড়ি পাতা শাখার (এলআইসি) কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ফেসবুক পেজটি চালু হওয়ার পর আট মাসে ১০ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। তাদের হটলাইনে কল আসে প্রায় ১৬ হাজার। ই-মেইল আসে তিন শতাধিক। অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি কামরুল হাসান হিমেল নামে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার এক প্রতারক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর পার্সোনাল অফিসার শেখ রেফায়েত উল্লাহ পিটুর নাম ও ছবি ব্যবহার করে একটি আইডি খোলে। সেখানে প্রতারক প্রধানমন্ত্রীর সাথে পিটুর যুগ্ম ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ তাতে বিশ্বাস করে ওই আইডিতে চাকরি, বদলি, পদোন্নতি, জমি ও বাড়ি দখল ইত্যাদির জন্য তার কাছে সাহায্য চায়। এ সময় প্রতারক একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেয় এবং সেখানে সাহায্য প্রার্থীরা যোগাযোগ করে। প্রতারক বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এতিমখানার কথা বলে বিভিন্ন নম্বরে বিকাশে ও নগদে টাকা গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য সে নিজেকে ১৫তম বিসিএসের একজন কর্মকর্তা ও প্রধানমন্ত্রীর পার্সোনাল অফিসার পরিচয় দিত। সে মাঝে মাঝে মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত এসাইনমেন্ট অফিসার নুর নবীকে তার নিজের পিএস হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করত। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের একটি টিম কামরুল হাসান হিমেলকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করে। দুই মাসে ওই প্রতারকচক্র কয়েক লাখ টাকা প্রতারণা করে নিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে, সাইবার অপরাধ ধারণার চেয়েও বেশি বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দেশে সাইবার ক্রাইম ধারণার বাইরে বেড়ে যাচ্ছে। তাই সাইবার অপরাধ দমনে আমরা সেভাবেই পুলিশকে তৈরি করছি। যদিও এটি এখন ছোট আকারে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে এটিকে বড় আকারে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান তিনি। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন