মাও. এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ এক ॥
হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। উপার্জন হালাল না হলে বান্দার দোয়া ও ইবাদত কোনো কিছুই কবুল হয় না। তাই মুমিনের প্রধান দায়িত্ব হালাল উপার্জন করা এবং হারাম বর্জন করা। কিন্তু যথাযথ জ্ঞান না থাকায় অনেকেই জড়িয়ে পড়ে হারামের সাথে। ফলে নষ্ট হয় সারা জীবনের আমল ও ইবাদত। সাধারণ মুসলমানকে হালাল-হারাম সম্পর্কে সচেতন করতে আমাদের এ বিশেষ আয়োজন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন করে তা হলো- কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যমে ব্যতীত কোনো ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের যাবতীয় মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। সে লক্ষ্যে তিনি মহাবিশ্বের সব সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্য) তৈরি করেছেন।’ [সুরা বাকারা-২৯] তবে এ ক্ষেত্রে তিনি মানুষকে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা যা তার ইখতিয়ারভুক্ত একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। ফলে প্রত্যেকে স্ব-স্ব যোগ্যতা, মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যেমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস চালায়।
মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানুষের জীবন নির্বাহের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে সমাদৃত, মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ মানুষকে এর গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য কুরআনে সালাতের পাশাপাশি জাকাত তথা অর্থের উল্লেখ ৮২ স্থানে করেছেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ অর্থনৈতিক বিধানও নির্দেশ করেছেন। ফলে কুরআনুল কারিমকে একটি অর্থবিদ্যার মহাকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মানুষ কীভাবে উপার্জন করবে, কোন পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণাবলীয় সম্পর্কে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা কুরআনে বিদ্যমান। তাইতো ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদে তিনি জাকাত ফরজ করেছেন, যেনো সম্পদ এক শ্রেণির লোকদের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আল্লাহ তায়ালা ফরজ ইবাদত শেরে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন- ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ প্রদান করবে এবং আল্লাহকে স্মরণ করবে যাতে তারা সফলকাম হও।’ [সুরা-১০] এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন- ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়। [জামিউ লিআহকামিল কুরআন, আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ কুরতুবি, খন্ড-১৮, পৃষ্ঠা-৯৬]
এখানে উপার্জনের একটি মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তাহলো এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইসলাম তা অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হলো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে যদি কখনো আল্লাহর স্মরণে ব্রত হওয়ার আহবান আসে, তাহলে তখন যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্ম পরিহার করা সকল ঈমানদারদের জন্য ওয়াজিব। [সুরা জুমা-৯]
জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে বিদেশে পাড়ি জমানোরও নির্দেশও রয়েছে এবং এটিকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সমপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে দেশভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।’ [সুরা মুজাম্মিল-২০]
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বলেন- ‘অর্থাৎ যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও রিজিক উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায় পৃথিবীতে ভ্রমণরত।’ [তফসিরুল কুরআনিল আজিম, আবুল ফিদা ইসমাইল ইবনে ওমর ইবনে কাসির, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা২৫৮]
তাছাড়া ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহিত করেছেন এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন। এ মর্মে যুবায়ের ইবনে আউয়াম রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সা. বলেন- ‘তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক, পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রয় করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুক এটা তার জন্য মানুষের নিকট ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক তার চেয়ে উত্তম।’
[সহি মুসলি: ১০৪২]
অতএব উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতীত যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয় তাদের জন্য এ ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখম-লে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।’ [সহি মুসলিম: ১০৪০]
ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুস্থ মানবতার সেবায় দান করার রীতি ইসলামে চালু আছে। তবে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেব গ্রহণ করতে ইসলাম অনুমোদন দেয়নি। বরং একে বার বার নিরুৎসাহিত করেছে যা নিষেধের পর্যায় পৌঁছে গেছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম নিজ হাতে উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ মর্মে হাদিসে এসেছে- হজরত রাফে ইবনে খাদিজা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সা. কে জিঙ্গেস করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন- ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়। [মুসনাদে আহমদ, খন্ড-৪ ১৪১]
নবী রাসুলগণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা নিজ হাতে কর্ম স্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের প্রিয়নবী সা. এর জীবনে প্রাথমিক সময়ে ছাগল চড়ানো ও পরবর্তীতে খাদিজা রা. ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহে উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবনব্যবস্থার নাম। এত মানবজীবনের ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমত পূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাবতীয় অক্যল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতিকে সতর্ক করেছে। অতএব, ইসলাম মানব জাতির জন্য কল্যাণের আঁধার হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে মানবদেহের জীবনীশক্তি হিসেবে রক্তের যে গুরুত্ব রয়েছে, মানবজীবনে অর্থের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে অর্থ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ তায়ালা তার নির্ধারিত ফরজ ইবাদত সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষণে জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে ব্রতী হয়। রাসূল সা. নিজের পরিশ্রম লব্দ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন