নূরুল ইসলাম
স্কুল কলেজ পড়–য়া শিশু কিশোরদের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। এ নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রযুক্তি নিয়ে শিশু-কিশোরদের অতি আগ্রহ ও সহজলভ্যতা শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোন নিয়ে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হয়েছে। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের নিষিদ্ধ। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইলের মাধ্যমে শিশুরা যে শুধু তার পরিবারের সদস্য, শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে তা নয়, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে তারা পর্ণো ছবির প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে। মোবাইলফোনের মাধ্যমে অল্পবয়সী শিক্ষার্থীরা নিজেদের তোলা আপত্তিকর ছবি ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে অভিভাবকরা আবদার পূরণের জন্য শিশুদের হাতে সহজেই তুলে দিচ্ছে মোবাইল সেট। যা শিশুদের নৈতিকস্খলনের সাথে কখনও কখনও ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। গত রোববার ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় মোবাইল ফোনে ট্রেনের ছবিসহ সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, সারা পৃথিবীতে শিশুদের অবাধে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। আমাদের দেশে এ নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। তিনি বলেন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় মর্মান্তিক এ ঘটনার পর সরকার শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে একটি সার্কুলার দিতে পারে। এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, মোবাইল ফোন এখন মানুষের মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানায়। এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাই যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন তাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুদের বিষয়ে অবশ্যই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, সরকার গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। একই সাথে স্কুল কলেজগুলোতেও ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে।
বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমাদের দেশে শহর থেকে শুরু করে একেবারে অজপাড়াগাঁয়েও শিশু কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন দেখা যায়। তারা মোবাইলে ছবি তোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। ১৮ বছরের কম বয়সীরা পাড়া-মহল্লর দোকান থেকে অবৈধভাবে সিম ক্রয় করে আইনের লঙ্ঘনও করছে। শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এই প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে সেলফির উন্মাদনায় বয়স্কদের তুলনায় এখন শিশু কিশোররাও পিছিয়ে নেই। টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেবেকা পারভীন বলেন, শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে কারণও আছে। আজকাল কোচিংয়ে পড়া ছাড়া ভালো রেজাল্ট করা যায়না। সন্তান কোচিংয়ে গেলে বাবা-মা উদ্বিগ্ন থাকে। এজন্য শিশু বলেন আর কিশোর-কিশোরী বলেন তাদের হাতে বাবা-মায়েরা মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিচ্ছে। আর সেটাই কেউ কেউ অপব্যবহার করছে। অনেকেই বলেছেন, স্কুল, কলেজ বা কোচিংয়ে পড়তে গিয়ে মোবাইলফোনে সংযুক্ত ক্যামেরা দিয়ে স্কুল-কলেজের ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলছে সহপাঠী মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি। পরে ছবিগুলো অপব্যবহার করে আপত্তিজনকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীদের মোবাইল সেট ও ইন্টারনেটে। অন্যদিকে, হঠাৎ মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে কৌতূহলবশত অবুঝ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের কথোপকথনে অপরিচিতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে। এদের অনেকে পরবর্তীতে ফোনে কথা বলা যুবকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর প্রতারিত হয়ে আবেগবশত এই কিশোরীরা কখনও কখনও বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। কিছুদিন আগে বখাটে যুবক ওবায়দুলের ছুরিকাঘাতে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রাশি নির্মমভাবে খুন হয়। দর্জির দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল জামা বানানোর ডেলিভারি সিøপ থেকে রিশার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাকে প্রেম নিবেদন করে। সেই প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় শেষ পর্যন্ত বখাটে ওবায়দুল তাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ছুরিকাঘাত করে খুন করে। এখানেই শেষ নয়, সাম্প্রতিককালে রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর বড় একটি কারণ মোবাইল ফোন। মোবাইলে কথা বলতে বলতে বা গান শুনতে শুনতে রেললাইন ধরে হাঁটা বা পার হওয়ার সময় মারা পড়ছে অনেকে। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবমতে, নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেলওয়ে থানা এলাকায় চলতি বছরের ৯ মাসে ২৩০টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৬ জন মারা যায় মোবাইলে কথা বলতে বলতে রেললাইন পার হওয়ার সময়। একদিন আগে গত রোববার ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ঘটেছে এমন এক মর্মান্তিক ঘটনা। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ভাদুঘর ভূইয়াপাড়া এলাকায় চলন্ত ট্রেনের ছবি তুলতে গিয়ে আরেক ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয় তিন শিশু। এরা হল- ভাদুঘর ভূইয়াপাড়া এলাকার আনিস মিয়ার ছেলে পারভেজ (১৪), বাহার মিয়ার ছেলে মোনায়েম রিপন (১২) ও বিজয়নগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কাউছার মিয়ার ছেলে শুভ (১১)।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে বাড়ির পাশে রেললাইনে বসে শুভ, পারভেজ ও রিপন কথা বলছিল। এ সময় পাশের লাইনে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর সোনারবাংলা ট্রেন এলে তারা মোবাইল ফোনে ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে পড়ে। উল্টো দিক থেকে তাদের লাইনে আসা ভৈরবগামী সুরমা ট্রেনন এলেও তারা খেয়াল করেনি। ট্রেনের নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই শুভ ও পারভেজের মৃত্যু হয়। পরে স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় মোনায়েমকে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ঢাকায় আনার পথে মোনায়েমের মৃত্যু হয়।
ছবি তোলা ছাড়াও ইদানিং বয়স্কুদের সাথে শিশু কিশোরদের মধ্যেও সেলফির উন্মাদনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু কিশোরদের মধ্যে সেলফির উন্মাদনার জন্য অভিভাবকরাই দায়ী। কারণ তাদের দেখেই শিশুরা শিখবে-এটাই স্বাভাবিক। বড়দের দেখাদেখি শিশু কিশোররা তাই করছে। নিমিষেই সেই সেলফি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে করে শিশুদের মানসিক বিকৃতি ঘটার আশংকা রয়েছে বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সেলফি নিয়ে গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা এক ধরণের মানসিক রোগ।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। তবে বেশিরভাগ বেসরকারী স্কুলগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয়না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্লাহ বলেন, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে এখনও ৯৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে শিশু-কিশোররা। এজন্য তাদের অভিভাবকরাই বেশি দায়ী। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় শিশু-কিশোররা কোনোভাবেই ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে না। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি একটা নিয়ম করা উচিত। এজন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষকদের মাধ্যমে শিশুদের সচেতন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এই সমাজ বিজ্ঞানী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন