দেশে মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর বোরো ধান চাষ অধিকাংশই সেচনির্ভর। শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি পানি সেচ দেয়া হয় ডিজেলচালিত পাম্প দিয়ে। কাজেই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কৃষিখাত। চলতি রবি ও বোরো মৌসুমে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ গড়ে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। জমিতে হালচাষ, সেচ দেয়া, মাড়াই, পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট খাতে এসব অর্থ ব্যয় হবে। বাড়তি খরচ করে উৎপাদনের পর ন্যায্য দামে বিক্রি করা যাবে কি-না সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক। এটা আসছে বোরো চাষের জন্য অশনি সঙ্কেত। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ডিজেলের মূল্যবৃৃদ্ধিতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকারের যে চেষ্টা তাও ব্যাহত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষিকে সচল রাখার দাবি বিশেষজ্ঞদের।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডি’র ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও কৃষি অর্থনীতির চাকা অনেকটা সচল ছিল। এ অবস্থায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষিখাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আসছে বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এতে ন্যায্য দাম না পাওয়ার আশঙ্কায় বোরো চাষে কৃষক আগ্রহ হারাতে পারে। আর এমনটা হলে বোরো মৌসুমে উদপাদন ব্যাহত হবে এবং তাতে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ হওয়া কঠিন হবে। তাই বোরো আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষিখাতে বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসছে বোরো মৌসুমে দুই কোটি ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল এবং ২ লাখ ৭০ হাজার বৈদ্যুতিক পাম্প রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১৬ লাখ টন ডিজেল সেচে ব্যবহার করা হয়। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বপ্রথম এই বোরো আবাদে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কৃষি বিভাগকে এর প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে বোরো আবাদে নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বোরো আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। সরকার তো সার-বীজে ভর্তুকি দিচ্ছে, যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ডিজেলেও কৃষক পর্যায়ে ভর্তুকির বিষয়টি সরকার অবশ্যই ভাববে আশা করি।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। আর কিছুদিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জমিতে সেচ দেয়া শুরু হবে। এ সেচ দেয়ার যন্ত্রের (পাওয়ার টিলার) প্রধান জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ১৫ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষকের মাথায় হাত। দেশের বেশিরভাগ কৃষক শুষ্ক মৌসুমে ফসল ফলাতে একেবারেই সেচের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে দেশে সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দিকে যাবে। দাম বাড়ার ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি খরচ দিয়ে ফসল উৎপাদনের পর কৃষক পণ্যের দাম না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বোরো মৌসুম, এ সময় ব্যাপকভাবে ডিজেল ব্যবহার হয়। খরচ বাড়ার কারণে কৃষক চাষাবাদ কমিয়ে দেবে, এতে আমাদের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। দাম বাড়ার ফলে গ্রামীণ জীবনে ব্যয় বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৯ টন। যা মোট চাহিদার ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতি লিটার ৬৫ টাকা হিসাবে এ খাতে কৃষকের খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গত অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এ খাতে ডিজেলের চাহিদা ধরা হয়েছে ১১ লাখ টন। ৮০ টাকা হিসাবে এ খাতে কৃষকের খরচ হবে ১০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ছে। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা বাড়ায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। শুধু মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি খাতে কৃষককে বাড়তি ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
কৃষকরা বলেছেন, এমনিতেই সেচ সৌসুমের শুরুতে কৃষি যন্ত্রপাতি ওভারহোলিং করতে তাদের বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। সেখানে সেচ খরচ বেড়ে গেলে তাদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাদের বক্তব্য, কিছুদিনের মধ্যে বোরো আর রবিশস্যের জন্য মাঠ প্রস্তুত করবেন তারা। সেজন্য ব্যবহার হবে সেচ পাম্প-পাওয়ারটিলার। কিন্তু হঠাৎ করেই ডিজেলের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। পরে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পারলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার শুনই গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর বলেন, আসছে বোরো মৌসুমে ১ বিঘা জমিতে ইরি ধান চাষে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার সেচ খরচ হয়। এবার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আরও ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া কলের লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষের জন্য খরচ বাড়বে। তাই এবার গরিব কৃষকদের পক্ষে চাষাবাদ করা খুবই কষ্ট হবে। আবার চাষাবাদ না করলেও কৃষক খাবে কী। তাই কৃষকদের জন্য এবার জীবন-মরণ সমস্যা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সূত্র জানায়, কৃষির সবচেয়ে বেশি ফলন হয় রবি মৌসুমেই। এ মৌসুম শুরু হয়েছে নভেম্বর থেকে, চলবে মে পর্যন্ত। এই সময়েই জ্বালানির চাহিদার বড় অংশ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে নভেম্বরে ৫ শতাংশ, ডিসেম্বরে ১০ শতাংশ, জানুয়ারিতে ১২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ২৪ শতাংশ, মার্চে ২৬ শতাংশ, এপ্রিলে ১৮ শতাংশ এবং মে মাসে ৫ শতাংশ। বাকি সময়ে সেচ ও হালচাষ খাতে জ্বালানির ব্যবহার হয় না বললেই চলে। তবে পরিবহণ খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। বিএডিসির হিসাবে সারা দেশে প্রতি বছর কৃষি জমিতে ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬২৭টি সেচ যন্ত্র চলে। এর মধ্যে ডিজেলে চলে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৮৫১টি। বাকি ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৬টি চলে বিদ্যুতে। প্রতি বছরই কৃষি খাত যান্ত্রিকীকরণ করা হচ্ছে। এ কারণে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি এমন একটা পণ্য যার মূল্য বাড়লে মূলত সবকিছুর দামই বেড়ে যাবে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও বিপণন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি দামে পণ্য উৎপাদন করে আবার বাড়তি দামেই বিক্রি করতে না পারলে কৃষক ব্যয় সামলাতে পারবে না। তখন তারা চাষাবাদ কমিয়ে দেবে। এতে উৎপাদন কমে যাবে। সরবরাহ সঙ্কট দেখা দেবে। এতে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ধান ছাড়াও কৃষির অন্য খাতেও সেচযন্ত্রের বহুল ব্যবহার হয়। যেমন শীতকালীন সবজি, পুকুর ও ঘেরে মাছ চাষে সেচযন্ত্রের ব্যবহার হয়। জমি চাষ থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন, নৌযান চালানোর মতো কাজে সারা বছর শ্যালো মেশিনের ব্যবহার হয়। এসব যন্ত্র ডিজেলনির্ভর। ব্রি’র হিসাবমতে, শুধু ধান রোপণ বা চাষাবাদে নয়, মাড়াই, পরিবহনের কাজেও ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন ব্যবহৃত হয়। ধান ছাড়াও নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজি, গম, সরিষা, ভুট্টাসহ প্রধান ফসলগুলো উৎপাদিত হয়। বৃষ্টিহীন এ মৌসুমে সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে সব ধরনের কৃষিপণ্যের ওপরে ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধির চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন