মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি স্কুল নিয়ে যুবকের আবেগঘন পোস্ট

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৫ পিএম

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র ইউনিয়নের দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার বনাঞ্চল এলাকায় সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আলোর ভুবন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এলাকার বন্ধুদের নিয়ে অবৈতনিক এ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত করেন স্থানীয় যুবক ও বেসরকারি চাকুরে জাহাঙ্গীর কবির। প্রতিষ্ঠার পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৩ বছরের মাথায় ২০২০ সালে মহামারি করোনার কারণে দেড় বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়টি।

এতে বেকায়দায় পড়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে আলোর ভুবনও পুরোদমে চালু হয়। কিন্তু দরিদ্র এলাকা হওয়ায় অভিভাবকরা এত টাকা খরচ করে সন্তানের পড়াতে পারছেন না। এতে অর্থাভাবে শিক্ষকদের বেতন কিছুদিন চললেও ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) বেলা ৩টার দিকে বিদ্যালয়ের পরিচালক তার নিজের ফেসবুক আইডি (Zahangir Kabir) থেকে শিক্ষার্থীসহ আলোর ভুবন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বিক্রি করার ঘোষণা দেন। পাঠকদের জন্য তা হবহু তুলে ধরা হলো—

‘১০০ জন ছাত্রছাত্রীসহ একটা স্কুল বিক্রি হবে’

প্রিয় দেশবাসী
আমার সালাম/আদাব গ্রহণ করবেন। আমি জাহাঙ্গীর কবির। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার সন্তান। পর সমাচার এই যে, আমি ২০০৮ সালে অত্র এলাকায় দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমার সাথে আমার এলাকার তরুণ বন্ধুরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিদ্যালয়টি এগিয়ে চলার ১৪ বছর ছুঁয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলে আমাদের বিদ্যালয়ও বন্ধ রাখা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ মাস বন্ধ ছিল বাংলাদেশের স্কুল কলেজ। যেহেতু মহামারী, তাই আমরা আমাদের শিক্ষকদের ছাঁটাই না করে বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে শিক্ষকদের বেতন দিয়েছি যতদিন যতটুকু দেয়া সম্ভব হয়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী আমরাও করোনাপরবর্তী বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু করেছি।

করোনার কারণে দেশের শত শত বেসরকারি স্কুল একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। যেহেতু আমাদের এলাকায় কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই এবং এটিই একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাই আমরা এলাকার শিশুদের কথা চিন্তা করে স্কুলটি বন্ধ করে দিইনি। দীর্ঘ ১৪ বছরে বনাঞ্চলের এই বিদ্যালয় থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। এই বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যতেও অসংখ্য আলোকিত মানুষ বের হবে এখান থেকে। গত ১৪টি বছর আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এই বিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছি। আমার অস্তিত্ব বলতে আমি কেবল আলোর ভুবন স্কুলকেই ভেবেছি। কখনোই নিজের শখ আহ্লাদের কথা চিন্তা করিনি। বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য আমি একটা প্যান্ট দিয়েই বছর পার করে দিয়েছি। কোনোরকম একটা শার্ট, এক জোড়া জুতা হলেই বছর পার করে দিয়েছি। জব করে যা বেতন পেতাম, তার সিংহভাগই আমি ব্যয় করেছি এই স্কুলের পিছনে। বিদ্যালয় নিয়ে আমার স্বপ্নটা থাকত মায়ের কাছে সন্তান যেমন থাকে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আজকের এই সুন্দর অবকাঠামো। এর পিছনে আপনাদের অনেকের সাহায্য-সহযোগিতা রয়েছে। যারা সারাজীবন আলোর ভুবনের পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি আবার চির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

১৪ বছর আগে এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ফুটপাতে ক্লাস করত। তখন এত সুন্দর কিছুই ছিল না। আমি মানুষের ভাঙা বাড়িতে বাচ্চাদের ক্লাস নিয়েছি, ক্লাস নিয়েছি চায়ের দোকানের বেঞ্চগুলিতে, পরিত্যক্ত ক্লাব ঘরে। ধীরে ধীরে আজকের এই নয়নাভিরাম স্কুল। বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য ইতিমধ্যে আমি অসংখ্য মানুষের কাছে বিদ্যালয়ের সংকটের কথা জানিয়েছি। দ্বারে দ্বারে গিয়েও পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য মাসে প্রায় ২৫ হাজারের মতো টাকা লাগে। এই বিশাল পরিমাণ অর্থের জোগান দেয়া আমার একার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অপর দিকে এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। দিন এনে দিন খায়। কারোর পক্ষেই বেতনভুক্ত স্কুল হিসেবে ২০০/৩০০ টাকা মাসিক বেতন দেয়া সম্ভব নয়।

সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বেতন করলেও মাসে দেখা যাবে সর্বসাকুল্যে ৪/৫ হাজারের মতো উত্তোলন হচ্ছে, যা একজন শিক্ষকের বেতনেরও কম। দীর্ঘদিন টেনেটুনে, শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে বেশ কিছু লোন হয়ে আছে। এমতাবস্থায় বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখার মতো কোনো উপায় আমার জানা নেই। যেহেতু ১৪ বছরেও কোনো সরকারি সহযোগিতা আমরা পাইনি, তাই সরকারি সহযোগিতার আশাও বাদ দিয়েছি। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি বিদ্যালয়টির দায়িত্ব নিতে চাইলে বর্তমান পরিচালক হিসেবে আমার কোনো আপত্তি নেই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়টির সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করতে আগ্রহী হয়, তাতেও আমি স্বাগতম জানাব। তবুও আমার মননে, মস্তিষ্কে, রক্তে মিশে থাকা বিদ্যালয়টি চলমান থাকুক।

বিদ্যালয়হীন বনাঞ্চলের শিশুরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক । প্রাণচঞ্চল থাকুক মানুষ গড়ার কারখানাটি। আমি ১৪ বছর এগিয়ে এনেছি। জানি না কতটুকু করতে পেরেছি। সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক কিছুই করা হয়নি। ইচ্ছে ছিল অনেক কিছুই করার। এই দীর্ঘ ১৪টা বছর আপনারা অনেকেই আমাকে সাপোর্ট করেছেন, পাশে থেকেছেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। বিদ্যালয়ের এই নিদারুণ ক্রান্তিকালে আপনাদেরকেও এই সিদ্ধান্তটি জানানোর প্রয়োজন মনে করেছি। এ বিষয়ে পরিচালক জাহাঙ্গীর কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ১৩ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। সারাজীবনের অর্জন ঢেলেছি এ প্রতিষ্ঠানে। চাই না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাক। তাই বাধ্য হয়ে ফেসবুকে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন