দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শক্তির অপব্যবহার এবং অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে বাড়ছে মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর এ কারণেই স্বচ্ছতা, আল্লাহভীতি ও জবাবদিহিতামূলক সংস্কৃতি গড়ে ওঠছে না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে দুর্নীতি বন্ধের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কোন কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আরো বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল অর্জিত হয়নি। তবে কিভাবে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে সেটা এখন বিশ্বব্যাপী একটি জিজ্ঞাসা। এ লক্ষ্যে আলোচ্য প্রবন্ধে দুর্নীতির পরিচয়, উৎপত্তি ও বিস্তার, পরিধি, উৎস, কারণ, দমন করার উপায় ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম কি ধরণের বিধান প্রণয়ন করেছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দুর্নীতির পরিচয় ঃ দুর্নীতি কী? প্রথমেই আমাদেরকে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে। দুর্নীতি একটি নেতিবাচক শব্দ। সহজ ভাষায় বুঝি কু-নীতি, কু-রীতি। নীতি বহির্ভূত কর্মকাণ্ড। ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৭, পৃ. ৩৩৯।’ আরবী ভাষায় একে ফাসাদ বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘যে সব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে: তাদেরকে হত্যা করতে হবে কিংবা শূলিবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের নির্বাসিত করা হবে।’ ‘আল-কুরআন, ৫ : ৩৩’ আরবী জারীমা শব্দকেও এর সমার্থক শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী কাজ। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো crime, offense তাছাড়া Moral degeneration; a malpractice, a corruption, perversion (বদমায়িশি), wickedness, Improbity, dishonesty (অসততা), a diversion from the true path (সৎ পথ থেকে বিপথে গমন)। ‘Samsad Bangali-English Dictionary, Calcatta: Sahitya Samsad, 1988, P. 443.’ যার বিপরীত হলো Moral, Morality or relating to the conduct of men; The doctrine or practice of the duties of life. Oxford Dictionary, Edited by Oxford University Press. Oxford Learners Favorite Dictionary Edited by Prof. Raihan Kawsar & Khairul Alam Monir, Published by Chowdhury & Sons, Dhaka: Banglabazar, 2006.’
Oxford English Dictionary তে বলা হয়েছে, Dishonest, illegal behabior, especially of people in authority, elegations of bribery. A. S Hornby, Oxford Advanced Learners of Current English, Oxford University Press, 2000, p-201’ অর্থাৎ ‘দুর্নীতি হল অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিবর্গের আইন বহির্ভূত আচরণ, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ইত্যাদি’।
দুর্নীতি হলো সমাজে প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরণের অপরাধমূলক আচরণ। ‘ড. মুহাম্মদ জাকির হোসাইন, আর্থ সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪, পৃ. ৪০৭।’
সাধারণত ঘুষ বলপ্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যক্তি বিশেষকে সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা অর্জনের নাম দুর্নীতি। ‘প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৭-৪০৮।’
রমনাথ শর্মার মতে, In corruption a person willfully neglected his specified duty in order to have an undue advantage. ‘প্রাগুক্ত’ অর্থাৎ ‘অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলার নাম দুর্নীতি’।
World Bank কর্তৃক প্রদত্ত দুর্নীতির সংজ্ঞা হলো: Corruption is the abuse of public power for private benefit. ÔVito Tanzi, Õ Corruption around the world causes, consequencesscope and cures in Governance, corruption & economics performanceÕ edited by George T. Abed & Sanjeev Gupta Washingto International monetary Fund, 2002, P. 25 অর্থাৎ ‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার।’
Trancparency International (TI) Ges Corruption Perception Index (CPI) প্রতিবেদনে দুর্নীতি বলতে সরকারি ক্ষমতা ও সুবিধাকে বেসরকারি বা ব্যক্তি স্বার্থে অপব্যবহার এবং সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিকে বুঝানো হয়েছে। ‘আবদুন নূর, ‘আদর্শ, উন্নয়ন ও দুর্নীতি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ তা. বি. পৃ. ১৭-১৮।’
Trancparency International এর সংজ্ঞা হলো: Corruption is the abuse of public office for private gain. অর্থাৎ “সরকারি দফতরকে ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগানো, যেখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।” “মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন, দুর্নীতি ও উন্নয়ন : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, ঢাকা: মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, মার্চ-২০০৬, পৃ. ৪৩”।
M.Johne এর মতে, ‘Corruption is missuse of public property, public rank and status for private interest. æPolitical Conference of corruption Comparative Politics, P.460
দুর্নীতি কেবল সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত নয়; বরং সরকারি, বেসরকারি, এনজিও বিভিন্ন পেশা, শ্রেণী, পরিবার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থেও হতে পারে। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারেন, যা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে অথবা সরকারি বাজেটের টাকা দিয়ে টেন্ডার ছাড়াই কোন কাজ নিজের বা দলীয় লোকদের মাধ্যমে করানো অথবা টেন্ডার দিলেও কাজের মান যথাযথভাবে ঠিক না রেখে কিছু টাকা খরচ করে বাকি টাকা নিজের পকেটস্থ করাও দুর্নীতি হিসেবে গণ্য হবে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, দুর্নীতি হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, আইনকানুন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভুত এমন এক পরিস্থিতি যা সঠিকভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত করে। অন্য কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবৈধ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বলে।
দুর্নীতির উৎপত্তি ও বিস্তার ঃ সভ্যতার প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রচলন কমবেশি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত প্রশাসনের উৎপত্তির সাথে সাথেই এর প্রচলন ও বিস্তার ঘটতে থাকে। এটি মানুষের ‘ফিতরাত’ তথা স্বভাবের একটি মন্দ দিক। আসমানী কিতাব তাওরাত (Old Testament) এর বিকৃতি ছিল ইতিহাস বিখ্যাত একটি জঘন্য দুর্নীতি। ‘প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮’ প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় রাজতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য (Kautilya) তাঁর প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্র (Arthashastra) গ্রন্থে দুর্নীতির বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। ‘Vito Tanzi, Corruption around the world” P. 25' প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে দান্তে (Dnte) ঘোষণা করেন, আইন বহির্ভূত কর্ম সম্পাদন কিংবা স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাউকে প্রভাবিত করার জন্য ঘুষ-উৎকোচ প্রদানকারীর অবস্থান হলো নরকের সর্বনিম্ন স্তরে। ‘আবদুন নূর, প্রাগুক্ত পৃ. ১৯’ বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর কোন একটি নাটকে দুর্নীতিকে বিখ্যাত চরিত্রে রূপায়ন করেছেন। ‘প্রাগুক্ত পৃ. ১৯-২০’ আমেরিকার সংবিধানে ঘুষ উৎকোচ এবং প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যে অপরাধ সম্পাদনের কারণে সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইম্পিচম্যান্টের যোগ্য হতে পারেন। ‘Nooman John T, Bribes, New Yourk, 1984” ১৭৭৫ সালে ভারতবর্ষের ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং মীরজাফরের পত্নীকে দেড় লক্ষ টাকা উৎকোচ দেয়ার বিনিময়ে মুর্শিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে নিযুক্তি লাভ করেন। অবশ্য এজন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তাঁকে গভর্নরের পদ থেকে ইম্পিচ করেন। সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৮ সালে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা যাচাইয়ের জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (ACR) গ্রহণের নিয়ম প্রচলন করেন। ‘আবদুর নূর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬’
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৫৭ সালে এদেশে দুর্নীতি দমন ব্যুরো গঠন করে দুর্নীতি প্রতিরোধের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাড় করানো হয়। কিন্তু রাস্ট্র প্রধান কিংবা সরকার প্রধানের অধীনস্থ দফতরে পরিণত হওয়ায় এ ব্যুরো তার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এ দেশের প্রায় সকল সরকারের ক্ষেত্রেই কম-বেশী দুর্নীতির অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ কোন নতুন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপে বর্তমানে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি বছর যে অপচয় হয় তা হচ্ছে ১১,২৫৬ কোটি টাকা। ‘Transparency International, সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০০২’ ফলে সকল স্তরে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাচ্ছে। ২০১১ সালে এউচ তে বিনিয়োগের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। অউই-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তেরেসাখো বলেন, WEF-এর ২০১১-১২ রিপোর্টে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবকাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি। দৈনিক আমার দেশ, ২৩ মে- ২০১২
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন