রাবি রিপোর্টার ও ঝিনাইদহ জেলা সংবাদদাতা : সম্প্রতি এক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের (রাবি) নিহত শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপু। পরে এই ঘটনায় সাজাও পেয়েছিলেন তিনি। তবে এই ঘটনার পর থেকে ওই পরীক্ষা জালিয়াতি চক্রের কে বা কারা তাকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান নিহত লিপুর সেজো চাচা মো. বশির।
মো. বশির বলেন, ‘লিপুর সব ঘটনা তো আর জানতাম না। তবে কিছু দিন আগে সে (লিপু) আমাকে বলেছিলো, লিপু যে নিয়োগ পরীক্ষার জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলো, ওই চক্রের কে বা কারা তাকে নিয়মিত ফোন করতো। তাকে ফোনে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিতো। এই বিষয়টা নিয়ে লিপু খুব টেনশন করতো। সে আমাকে এরকম একটা ঘটনা বলেছিলো।’ তবে এর বেশি কিছু আর বলতে পারেননি লিপুর চাচা।
এই ঘটনায় জেরে মোতালেব হোসেন লিপু ‘হত্যা’র শিকার হতে পারে বলেও ধারণা করছেন লিপুর চাচা ও বন্ধু-বান্ধবরা। লিপুর প্রায় তিন বছরের ক্যাম্পাস জীবনে আর কারো সাথে কখনো দ্বন্দ্ব ছিলো বলে জানেন না কেউই। এমনকি গ্রামবাসীর চোখে লিপু হলো নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ‘সোনার টুকরো’ ছেলে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে লিপুর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিনাকন্ডু থানার মকিমপুর গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়। লিপুর গ্রামের বন্ধু ও বাড়ির আশেপাশের আত্মীয়স্বজন লিপুর কারো সাথে দ্বন্দ্ব ছিলো বলে ধারণা করতে পারছেন না।
গ্রামবাসীরা জানান, ‘লিপুর বাবা তাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি লিপু নিজেও সেটা বুঝতো। লিপু গ্রামে কারো সাথে কখনো বাগবিত-ায় জড়ায়নি।’
এদিকে মোত্তালিব হোসেন লিপুর হত্যাকা-ের একদিন পরেও কোন ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার জন আটক করা হলেও তার রুমমেটকে রেখে বাকি তিন জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে ছিলো, লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলাম, সহপাঠী প্রদীপ, দুইজন নৈশ্য প্রহরী মনির ও নয়ন।
এ বিষয়ে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, যেহেতু এটি খুবই সেনসেটিভ বিষয় তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকালই চার জনকে থানায় আনা হয়েছিল। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেই তার বন্ধু প্রদীপকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর দু’জন নৈশ্য প্রহরীকে আজ সকালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রুমমেটকে এখনো থানায় রাখা হয়েছে। তবে তাদের নিকট থেকে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখার আলম মাসউদ বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে লিপুর চাচা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামায় মামলা করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে এ হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে আসলে এখনো কোন কিছু পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
তবে লিপুর এমন হত্যাকা- নিয়ে রহস্যের গুঞ্জন থেকেই যাচ্ছে। লিপুকে তেমন কোন রাজনৈতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়নি। এছাড়াও আত্মহত্যার কোন আলামত পাওয়া যায়নি ময়না তদন্তে।
নিহতের মাথার ডান পাশে বড় ধরনের আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন রামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক ডা. এনামুল হক। এ হত্যাকা-ে জড়িত থাকতে পারে তার বদলি পরীক্ষা দেয়ার বিষয়। সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিপু কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে অর্থনৈতিক সংকটজনিত মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকতেন। বছরখানেক আগে একটি নিয়োগের পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে তিন মাস জেল খাটেন তিনি। পরে জামিনে মুক্ত হন। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কারো সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নবাব আব্দুল লতিফ হল থেকে লিপুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মোবাইলে হুমকি দেয়া হতো বলে মায়ের অভিযোগ
ঝিনাইদহের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপুকে তার রুমমেটরা হত্যা করেছে এমন আশংকা করেছেন লিপুর মা হোসনে আরা বেগম। তিনি অভিযোগ করেন লিপু গত পুঁজোর ছুটিতে বাড়ি আসলে এক রুমমেট তাকে ফোনে হত্যার হুমকী দেয়। তাদের মধ্যে উত্তেজনা ও কথাকাটাকাটিও হয়। আমি এ সময় লিপুকে বলেছিলাম কে হুমকি দিচ্ছে বাবা। তুমি তার মোবাইল নাম্বারটা দাও। লিপু এ সময় বলেছিলো আমার এক রুমমেট। এবার ফিরে এসো তার নাম্বার দেব। লিপু ফিরলো ঠিকই, তবে লাশ হয়েছে। এ কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন লিপুর মমতাময়ী মা। লিপু হত্যা রহস্য ফাঁস না হলেও ক্যাম্পাসে ফেরার আগের দিন লিপুর যে বন্ধুর সাথে কথাকাটাকাটি হয়েছিলো, সে সম্পর্কে গোয়েন্দারা খোঁজ নিলেই লিপু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হতে পারে। এদিকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মোতালেব হোসেন লিপুকে দাফন করা হয় তাদের পারিবারিক গোরস্থানে। দাফনের পর থেকেই এলাকা ও লিপুর পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বুক ফাটানো কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে গোটা গ্রামটি। কোন ভাবেই থামানো যাচ্ছেনা লিপুর হতভাগী মা হোসনেয়ারা বেগমকে। মায়ের মুখে একই কথা ঘাতকরা আমার ছেলেকে সাংবাদিক হতে দিল না। ওরা তাকে বাঁচতে দিল না। প্রতিবেশীরা জানান, একেবারেই নরম ও ভদ্র স্বভাবের ছিলেন মোতালেব হোসেন লিপু। বাড়িতে কম কথা বলতেন, ছিলেন অনেকটা চাপা স্বভাবের। সে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সাছে জড়িত ছিল না, পড়া-লেখাই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুরক্ষিত স্থানে থেকে তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে এমনটি মেনে নিতে পারছে না গ্রামবাসী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন