বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পশ্চিমা দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির -বেনজীর আহমেদ

প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় আলোচিত সংগঠন নব্য জেএমবির পশ্চিমা দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা ছিল বলে জানিয়েছে র‌্যাব। অতর্কিত হামলা করে দূতাবাসের কর্মীদের হামলার পরিকল্পনা করেছিল তারা। তবে কোন কোন দূতাবাসে এসব হামলার পরিকল্পনা ছিল সেটা জানায়নি বাহিনীটি। ধগতকাল সকালে রাজধানীতে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ।
নব্য জেএমবির সন্দেহভাজন প্রধান কথিত শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের উদ্ধার হওয়া নানা চিঠি, ই-মেইল এবং ক্ষুদে বার্তা পর্যালোচনা করে এ পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছে র‌্যাব।
গত ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় একটি বাড়িতে অভিযান চলাকালে পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে মারা যাওয়া আবদুর রহমানই নব্য জেএমবির কথিত প্রধান শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ বলে জানায় র‌্যাব। তবে আবদুর রহমান বা আবু ইব্রাহিম তার প্রকৃত নাম নয়। তার আসল নাম সারোয়ার জাহান। তাদের বাড়ি চাঁপাইনবাগঞ্জ উপজেলার ভোলাহাট উপজেলার থুমরিভুজা গ্রামে।
র‌্যাব জানায়, ২০০৭ সালে জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর নব্য জেএমবির জন্ম। র‌্যাবের ভাষ্যমতে ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট ও ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে দুটি হামলা চালিয়ে এক আওয়ামী লীগ নেতা ও কথিত পীরকে হত্যার মাধ্যমে অপারেশন শুরু করে তারা। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার, ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যাসহ আলোচিত সব গুপ্তহত্যাও এই সংগঠনের সদস্যরাই ঘটিয়েছে। তবে নব্য জেএমবির সবচেয়ে বড় অভিযান হয়েছে গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। ওই হামলায় ১৭ বিদেশি, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত হয় মোট ২২ জন। এর পর ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে হামলা চেষ্টাও এদেরই কাজ বলে জানিয়েছে র‌্যাব।
র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, নব্য জেএমবির কথিত প্রধানের কাছ থেকে তারা যেসব নথিপত্র উদ্ধার করেছেন তাতে বেশ কিছু হামলার পরিকল্পনাও ছিল। তিনি জানান, নব্য জেএমবি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় বাংলাদেশের মধ্যে একটি সেইফ জোন তৈরির পরিকল্পনা করেছিল।
বেনজীরের ভাষ্যমতে নব্য জেএমবি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে পরিকল্পনা কষেছিল সেটি কার্যকর হলে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে তোলপাড় হয়ে যেতো। তিনি জানান, জঙ্গিরা পশ্চিমা দূতাবাসে অতর্কিত আক্রমণ করে তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি র‌্যাব প্রধান। এই তথ্য পেয়ে দূতাবাসগুলোতে সতর্ক করা হয়েছিল কি না, সেই তথ্যও সংবাদ সম্মেলনে দেননি বেনজীর।
র‌্যাব জানায়, নব্য জেএমবির প্রধান লক্ষ্যর একটিই ছিল বিদেশি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে হামলা করা। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারায় বিদেশি নাগরিকদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করেই এগিয়েছিল তারা।
বেনজীর আহমেদ আরো জানান, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত বাংলাদেশ প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফই নব্য জেএমবির প্রধান। প্রাথমিক পর্যায় তার নাম আবদুর রহমান বলা হলেও তার প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান বলে জানিয়েছে র‌্যাব।
র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, প্রায় ১৩ বছর ধরে সে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। আশুলিয়ায় ৮ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে নিহত ব্যক্তিই আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। আব্দুর রহমানের বাসা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সাংগঠনিক অনেক নথিপত্রও উদ্ধার করা হয়। পরে তার পাসপোর্টের সূত্র ধরে প্রতীয়মান হয় যে আব্দুর রহমানের এ পরিচয় ভুয়া । এ ঘটনার ১২ দিন পর র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে, এই আব্দুর রহমানের প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের থুমরিভোজা এলাকায়।
র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘এই আবু ইব্রাহিম ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ১৯৯৮ সালের পর থেকেই জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সে ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী।’
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ সে নব্য জেএমবি গঠন করে এবং আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে এ সংগঠনের আমির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ বিষয়ে কিছু নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। নিজেকে আমির হিসেবে ঘোষণার একটি কাগজে আবু ইব্রাহিম অর্থাৎ আব্দুর রহমান ও তামিম চৌধুরী স্বাক্ষর করে। শেখ আবু নামটি তামিম চৌধুরীর সাংগঠনিক নাম।’ চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল আইএসের কথিত মুখপত্র দাবিক-এর ১৪তম সংখ্যায় আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকশিত হয়। সেখানে তাকে বাংলাদেশে আইএসের কথিত প্রধান বলে দাবি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘বাংলাভাই ও শায়খ আব্দুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে নতুন ধারার ধর্মীয় উগ্রবাদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরনো জেএমবি নব্য জেএমবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নব্য জেএমবি পরবর্তীতে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা করে এবং একই সঙ্গে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।’
বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এক পর্যায়ে নব্য জেএমবির সাধারণ সদস্যরা আব্দুর রহমানকে শূরা সদস্য হিসেবে মনোনীত করে। পরে অন্য শূরা সদস্যরা তাকে নব্য জেএমবির আমির হিসেবে ঘোষণা করে এবং তার সাংগঠনিক নাম দেয় শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আবদুর রহমানের বাসা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, মুঠোফোন, জিহাদি বই, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্টসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আবদুর রহমানের পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও কর্মস্থলের পরিচয়পত্র যাচাই করে তাঁর চেহারার কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর মা-বাবার সন্ধান পায় র‌্যাব। পরবর্তী সময়ে ছবি দেখে আবদুর রহমানকে শনাক্ত করেন তাঁরা। পরিবারের সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, আবদুর রহমানের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভোলাহাট উপজেলার মুশরিভুজা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল মান্নান, মায়ের নাম ছালেহা খাতুন।
কওমি মাদ্রাসা থেকে দাওরা পাস আবদুর রহমান বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী। তিনি প্রায় ১৮ বছর আগে ১৯৯৮ সালে জেএমবির কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ সালে জেএমবির নেতা বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় তিনি অংশ নেন। ওই মামলার ১৪ নম্বর আসামি ছিলেন আবদুর রহমান। এই মামলায় নয় মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। দেড় মাস গ্রামের বাড়িতে থাকার পর আবারও আত্মগোপনে চলে যান এই জেএমবি নেতা। ব্যক্তিগত জীবন দুটি বিয়ে করেছেন আবদুর রহমান। প্রথম স্ত্রীর সংসারে দুটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি সন্তান রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।
আবদুর রহমানের একাধিক চিঠি, ই-মেইল ও এসএমএস পরীক্ষা করা হয়েছে জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, নয়টি চিঠি গ্রহণ ও ১০টি চিঠি বিতরণ করেছেন তিনি। এসব চিঠিতে এই নব্য জেএমবি নেতা আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে স্বাক্ষর করেছেন। নব্য জেএমবির নিহত সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কাজও করতেন আবদুর রহমান।
আবদুর রহমান নব্য জেএমবির আর্থিক কর্মকা- পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা, সাংগঠনিক কাঠামো, অস্ত্র ও সামর্থ্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতেন। তাঁর নির্দেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসিকে, রাজধানীর গাবতলীতে দারুস সালাম থানার সহকারী উপপরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা, দিনাজপুর শহরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক ইতালির নাগরিক পিয়েরো পারোলারি সামিওকে হত্যা করে।
গত বছর পুরান ঢাকার হোসনি দালানে আশুরার তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা, নন্দনপার্কে শিল্প পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেন হত্যা, বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলা, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ইশা খাঁ নৌঘাঁটিতে বোমা বিস্ফোরণ, এ বছর পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে শ্রী শ্রী সন্ত গৌরীয় মঠে পুরোহিত যঞ্জেশ্বর দাসাধিকারীকে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী দেবেশচন্দ্র প্রামাণিক হত্যা, ৫ জুন নাটোরের বনপাড়ায় খ্রিস্টান পল্লিতে সুনীল গোমেজ হত্যা, ৭ জুন ঝিনাইদহের মহিষডাঙ্গা গ্রামে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি হত্যা, পাবনার হেমায়েতপুরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক নিত্যরঞ্জন পান্ডে হত্যা, ১৫ জুন মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলা, ১ জুলাই ঝিনাইদহে সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যা, একই দিন গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ও হত্যা, ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহ মাঠে হামলার ঘটনা আবদুর রহমানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় ঘটেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন