শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কাশ্মীরের আগুন বলিউডে

প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : বিনোদন হলো ‘মনের খোরাক’। মানুষের জীবনে বয়সভেদে বিনোদন অপরিহার্য। পরিবেশ, সমাজ, গোত্র, শিক্ষা, পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভর করে বিনোদনের রকমফের। বই পড়ে কেউ কবিতা-গল্প-উপন্যাসের মধ্যে খুঁজে পান বিনোদন। কেউ গান শুনে-সিনেমা দেখে, টিভিতে নাটক-সিরিয়ালের মধ্যে বিনোদন খোঁজেন। কেউ ঘুরে বেড়ানো, কেউ খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা করে, কেউ পরোপকার করে, কেউবা ধর্মকর্মের মধ্যেই বিনোদন খোঁজার চেষ্টা করেন। মানবজীবনে বিনোদন অপরিহার্য। মুম্বাইয়ের বলিউডের তৈরি ‘সিনেমার’ মাধ্যমে মানুষকে বিনোদন দিয়ে ভারত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বলিউডের হিন্দী সিনেমার চাহিদা বিশ্বব্যাপী। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত বিশ্বের দেশে দেশে সিনেমা ফেরি করে বলিউড ভারতের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর সেই গুরুদায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন ‘বলিউড কিং’ খ্যাত শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, সাইফ আলী খান, ইরফান খান, এ আর রহমান, জাভেদ আখতারের মতো মুসলিম শিল্পীরা। মুসলিম বিদ্বেষের কারণে সেই বলিউড ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে তপ্ত হয়ে উঠছে বলিউডের রুপালী জগৎ।
কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলনের খবর মিডিয়ায় ‘নিস্তেজ’ হয়ে আসলেও আন্দোলনের আগুনের উত্তাপ লেগেছে মুম্বাইয়ের বলিউডে। ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্ম যার গর্ভে সেই আরএসএস ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার মুসলিম বিদ্বেষে পাকিস্তানী শিল্পীদের পাশাপাশি বলিউডের মুসলিম নায়ক-নায়িকা-অভিনেতা অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী ও কলাকুশলীরা তোপের মুখে পড়ছেন। সিবসেনার হুমকিতে বলিউডের জনপ্রিয় একাধিক শিল্পী অভিনয় ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কারো কারো অভিনীত সিনেমা হলে প্রদর্শনে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে সীমান্তে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরেই ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রদর্শন এবং অনুষ্ঠানাদি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে ভারতের আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদে নেপাল সব ভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে প্রতিবেশি দুই দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রদর্শন বন্ধ হওয়ায় বিপুলসংখ্যক দর্শক হারিয়ে কার্যত চাপের মুখে পড়েছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো।
কাশ্মীরে আন্দোলন ঠেকাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে উত্তপ্ত হয়ে উঠে কাশ্মীর। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তারপরও চলে আন্দোলন। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর উরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলায় ১৮ সেনাসদস্য নিহত হন। রক্তাক্ত এই ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে। এরই জের ধরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন প- হয়। ভারত কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে একঘরে করতে কোমর বেঁধে মাঠে নামে। এ ঘটনায় হিন্দী সিনেমায় কর্মরত পাকিস্তানী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন শিবসেনা ও আরএসএস। মুম্বাইয়ের রুপালী পাড়া বলিউডে ‘পাকিস্তানি অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পীদের কাজ দেয়া চলবে না’ এমন কঠোর দাবি তোলে শিবসেনার চলচ্চিত্র বিষয়ক শাখা ‘চিত্রপট সেনা’। শুধু তাই নয় পাকিস্তানী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনীত ছবির প্রদর্শনে বাধা দেয়ার হুমকি দেয়। ‘চিত্রপট সেনা’র মহাসচিব অক্ষয় বরদাপুরকর ঘোষণা দেন- ভারতের মহারাষ্ট্রের মাটিতে পাকিস্তানের অভিনেতা, ক্রিকেটার বা শিল্পীদের পা রাখতে দেয়া হবে না। এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘রইস’-এর পাকিস্তানি অভিনেত্রী মাহিরা এবং ‘ইয়ে দিল হ্যায় মুশকিল’-এর পাকিস্তানি অভিনেতা ফাওয়াদ খানের চলচ্চিত্র মহারাষ্ট্রে প্রচারে বাধা দেবার ঘোষণা দেয়া হয়। বলিউডের পরিচালক-প্রযোজকের কাছে চিঠি দিয়ে পাকিস্তানি শিল্পীদের বয়কট করার দাবি জানানো হয়। গত বছর পাকিস্তানের গজল শিল্পী গুলাম আলীর ভারত সফরের সঙ্গীতানুষ্ঠান করতে দেয়নি হিন্দু নেতা বাল ঠাকরের নেতৃত্বে জন্ম নেয়া ওই শিবসেনা। সিবসেনার এই হুমকির প্রতিবাদ করে বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান, প্রিয়াংকা চোপড়া, ওমপুরি, পরিচালক করণজোহর সিবসেনার এই হুমকির প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজনীতি করেন না। তারা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর তোপের মুখে পড়েন শাহরুখ খান। সিবসেনা তাকে (শাহরুখ) গালিগালাজ করে দেশ ছেড়ে পাকিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
বর্তমানে পাকিস্তানী অভিনেতা ফাওয়াদ খান, অভিনেত্রী মাহিরা খান, গায়ক আতিফ আসলাম, গায়ক-অভিনেতা আলি জাফর মুম্বাইয়ের বলিউডে জনপ্রিয়। পাকিস্তানী শিল্পীদের পক্ষ নিয়ে প্রিয়াংকা চোপড়া বলেছেন, ওরা অভিনয় করেন, রাজনীতিবিদ নয়। কাজেই কাশ্মীর ইস্যুতে শিল্পীদের জড়ানো উচিত হবে না। আমাদের উচিত রাজনীতি বিষয়টি রাজনীতিবিদদের উপর ছেড়ে দেয়া। একই মত দিয়েছেন করণজোহরও। একই ইস্যুতে পাকিস্তানি ও মুম্বাইয়ের মুসলিম শিল্পীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার প্রতিবাদ করেন প্রখ্যাত অভিনেতা ওমপুরি। ভারতে পাকিস্তানি শিল্পীদের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করতে গিয়ে প্রবীণ এই অভিনেতা উরির ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ওই জওয়ানদের কে বলেছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে? অস্ত্র হাতে তুলে নিতেইবা কে বলেছিল?’ তার এ মন্তব্য নিয়ে ভারতে অনলাইনে ওঠে বিতর্কের ঝড়। তার অভিনীত ফিল্মের প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয় এমএনএস। এর জের ধরে শেষ পর্যন্ত অভিনয় ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন ওমপুরি। মুসলিম বিদ্বেষী সিবসেনার কঠোর সমালোচনা করে ওমপুরি বলেন, ‘যারা আমার ছবি বয়কট করার কথা বলছেন, একদিন তারা শাহরুখ-সালমানের ছবিও বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন। তবে সেসব কথায় আমি গুরুত্ব দিই না! আমার চিন্তা অন্য বিষয়ে। আমার উপস্থিতির জন্য কোনো ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়া হলে বলিউডের অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই অভিনয় ছেড়ে দিচ্ছি। অভিনয় ছেড়ে দেয়ার ঘোষণার পর পাকিস্তানি এক টিভি সাক্ষাৎকারে ওমপুরি বলেন, ইসলাম ধর্মই হল পৃথিবীর সেরা ধর্ম। সবার উচিত ইসলাম গ্রহণ করা’। ওমপুরির আরো কিছু বক্তব্যসহ সাক্ষাৎকারের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সম্প্রতি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম ওই ভিডিওটি প্রকাশ করেছে। ফলে বলিউডের জ্বলে ওঠা উত্তাপে যেন ঢালা হলো ঘি।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বলিউডে পাকিস্তানি শিল্পীদের হুমকি দেয়ার বিপরীতে পাকিস্তান সরকার সে দেশে ভারতীয় টিভির খবর ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানসহ ভারতীয় সব টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করেছে। পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক মিডিয়া রেগুলেটর অথরিটি (পিইএমআরএ) এ সিদ্ধান্ত নেয়। গত শুক্রবার এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। নিষেধাজ্ঞার ফলে পাকিস্তানের ক্যাবল টিভি অপারেটররা বলিউডের কোনো গান, ছবিসহ ভারতীয় টিভির অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারছে না। উল্লেখ্য, ভারতীয় টিভি চ্যানেল বিশেষ করে চলচ্চিত্র বা বিনোদন বিষয়ক অনুষ্ঠান ও খবরাখবর পাকিস্তানের অনেক এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। ভারতীয় টিভি চ্যানেল বছরব্যাপী সিরিয়াল, নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংস্কৃতির আগ্রাসনে যেমন বাংলাদেশের দর্শকদের মগজ ধোলাই করেছে; পাকিস্তানের অবস্থাও একই। মুসলিম প্রধান দেশ হলেও হিন্দীর দাপটে পাকিস্তানে অনেক শহরের মানুষ পশ্চিমা দেশের মানুষের মতোই খোলামেলা ধাঁচে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পাকিস্তানের দর্শকের কারণে সে দেশের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে প্রচার হতো; পাকিস্তানি রুপি ডলার হয়ে ভারতে চলে যেত। টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার পাকিস্তানে বন্ধ হওয়ায় ভারতের মিডিয়াগুলো কিছুটা হলেও ধাক্কা খাবে। এর আগে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’ থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে’ রূপান্তর ঘটায় নেপালের প্রতি রুষ্ট হয় ভারত। তারা চানক্যনীতি গ্রহণ করে নেপালের জনগণের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি-ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক নেপালে প্রবেশে বাধা দেয়। অত:পর নেপাল সরকার সে দেশে ভারতীয় সব টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। প্রতিবেশি দেশের আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদে নেপালের পর পাকিস্তান ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যেন আরো বেশি করে ভারতীয় সাংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যতই ভারতমুখী হয়ে ভারতপ্রীতিতে মশগুল হোক না কেন; কাশ্মীরের আন্দোলনের আগুন যেভাবে বলিউডে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে ভারতের সিনেমা ব্যবসায় কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মুসলমানরাই ভারতবর্ষ শাসন করেছে শত শত বছর। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে। তারপর ইংরেজ খেদাও প্রতিটি আন্দোলনে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজ তোষামোদীতে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং জমিদার-জোতদারে হিন্দুদের অধিক সুবিধা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগেও সে প্রভাব পড়ে। এসব রাজনীতির কথা। কিন্তু সাংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা? বলিউড সিনেমায় মুসলমানদের অবদান স্মরণীয়। চল্লিশ দশকে মোহাম্মদ ইউসুফ খান পোশাকী নাম ‘দিলীপ কুমার’ ধারণ করে বলিউড সিনেমায় ঝড় তোলেন। ১৯৪৪ সালে তার অভিনীত ‘জোয়ার ভাটা’ বিশ্বের দেশে দেশে সংস্কৃতি অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেয়। বলিউডে তিনি ‘ট্রাজেডি কিং’ উপাধি পান। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে এ উপমহাদেশের তরুণদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়া নায়িকা নার্গিস খানসহ অনেক মুসলিম নায়ক-নায়কা বলিউড সিনেমাকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যান। তারই ধারাবাহিকতায় বলিউডের সিনেমা রফতানি করে লাখ লাখ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে ভারত। সেই হলিউডে এখন মুসলিম বিদ্বেষ! কি বিচিত্র তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের চেহারা!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
মহিউদ্দিন ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:১৮ এএম says : 0
সিবসেনাদের এই কার্যক্রম নিজেদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।
Total Reply(0)
বিপ্লব ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:২২ এএম says : 0
ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি ধর্মবিদ্বেষ ??????????????????
Total Reply(0)
রাজ্জাক ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:২৭ এএম says : 0
লেখককে মোবারকবাদ
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন