মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

আত্মার পরিশুদ্ধিতে ধর্ম

প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

॥ এক ॥
আত্মা বা রূহু জীবজগতের প্রধান উপাদান। যার বিহনে শরীর নিষ্প্রাণ, স্পন্দনহীন দেহ বা লাশমাত্র। যদিও সাধারণ জীবাত্মাও পরমাত্মার মাঝে প্রভেদ স্বীকৃত। মূলত ইহা ইন্দ্রিয়সমূহের আওতার বাইরে অবস্থান। যা মানব দেহকে সচল করার মাধ্যম বা দেহের প্রাণকেন্দ্র। সৃষ্টির এই অবিচ্ছেদ্য অংশ মানবাত্মা ও জীবাত্মার স্বরূপ জ্ঞান হতে তোমাদেরকে অতি সামান্য প্রদান করা হয়েছে ঃ আল কোরআন। তাই ‘ক্ষুদ্র জ্ঞানে উপলব্ধি করা শুধু অসম্ভবই নয় অবাস্তবও বটে। তাই সহজভাবে স্বরূপ, অস্তিত্ব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বলা হয়েছে ‘তারা আপনাকে (নবী সা.) রূহু হল আমভর প্রভুর আজ্ঞা ‘আল কোরআন’ এই আত্মা মহান আল্লাহ পাকের আজ্ঞাবহ। শত প্রতিবন্ধকতার নিñিদ্র আবরণ। ভেদকারী আত্মার কল্পনা ভেদ একমাত্র আল্লাহই জ্ঞাত। ‘নিশ্চয়ই তিনি বক্ষের মধ্যে লুকায়িত সমস্ত ভেদ রহস্য সম্পর্কে পরিজ্ঞাত ‘আল কোরআন’।
রূহ সারা শরীরে বিস্তৃত, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু ক্বলব/জীবাত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক আল্লাহর নবী (সা.) বলেন ‘নিশ্চয়ই মানুষের শরীরের মধ্যে একটা গোস্তের টুকরা আছে (উহাই ক্বলব)। প্রগতিশীল বিশ্বের উন্নয়নের হাতিয়ার ইসলাম, ধর্মের শ্মাশত আল কোরআন। মুসলিম ও অমুসলিম সবাই ‘সোর্স অব নলেজ’ ও ‘সোর্স অব সাইন্স’ হিসেবে খুঁজে পেয়েছে কোরআনকে। এ কোরআন গবেষণা মাধ্যমেই উদঘাটিত হয়েছে ক্রমোন্নতির পথ, সৃষ্টির রহস্য, সৌর বিজ্ঞান, আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের মিলন রহস্য, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, আরও অদ্ভুত রহস্যাবলী এবং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আত্মার অস্তিত্ব।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন ‘আত্মা’ কি? মানুষ মৃত্যুর সাথে সাথে দেহ থেকে কি বের হয়ে যায় এটি প্রমাণ করার জন্য একটি নিñিদ্র কাচ বাক্সে অক্সিজেন দিয়ে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে রাখা হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বাক্সের এক পাশে কাঁচ ফেটে যাবার সাথে সাথে ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। কিন্তু বুঝতে পারেনি কী বের হলো।
বৈজ্ঞানিকভাবে এটি পরীক্ষা ও গবেষণার জন্য লন্ডনে ‘সোসাইটি ফর রিসার্স’ স্থাপন করা হয়েছে। ১৮৮২ সাল থেকে আাজ পর্যন্ত আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে বহু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ জয় স্লেল বলেন, হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে দেহ থেকে ধোঁয়ার মতো একটা কিছু বের হয়। পরবর্তীতে এই ধোঁয়া দেহের আকৃতি নেয়। আধুনিক কালে বিশেষভাবে প্রস্তুত অতি সূক্ষè এক ধরনের ক্যামেরা দ্বারা বিলিয়ান ফটোয় দেহের ওপর বর্ণবলয় ধরা পড়েছে। ফরাসী চিকিৎসক ‘হিপ্লোলাইট বারডুক’ তার স্ত্রীর মৃত্যুর ১৫ মিনিট ও এক ঘণ্টা পর ছবি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াকৃতির আচরণ দেখতে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এই ধোঁয়া ‘একটোপ্লাজম’ দিয়ে দেহ গঠনের প্রমাণ দিয়েছেন বিজ্ঞানী ইভাক।
দৈহিক মৃত্যুর পর থেকে যে একটা কিছু চলে যায়, তা মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির দেহ ওজন করেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। এতে দেখা গেছে যে, প্রাণ চাঞ্চল্যের সবটুকু দেহ থেকে নিঃশেষে মিলিয়ে যাওয়ার পর দেহের ওজন অর্ধেক থেকে এক তৃতীয়াংশ আউন্স কমে যায়। এতেই আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় বিংশ শতাব্দির ক্রান্তিলগ্নে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, জীবাত্মার মাঝেই মানুষ সীমাবদ্ধ নয় বরং পরমাত্মাও আছে। যার জন্য জীবাত্মার মতো শক্তিশালী প্রাণময় সতেজ করার উপকরণ প্রয়োজন। আর ঐ উপকরণ হল তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান।
¯্রষ্টার সাথে নৈকট্যহীনতার কারণে সৃষ্টির মনের অনুভূতিতে যে তীব্র ব্যাকুলতা জাগে তা দূরীকরণের মাধ্যমই হল আধ্যাত্মিকতা। জীবাত্মা পরমাত্মার একটা অংশ মাত্র। পরমাত্মার কাছ থেকে জীবাত্মা বা মানবাত্মা এসেছে এবং পরমাত্মাকে রূপ ¯্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীর মায়ায় মোহে, কর্মকোলাহলে আমরা সবাই প্রতিনিয়ত ব্যস্ত হয়ে অনন্ত যাত্রার কথা ভুলে যাই, কিন্তু এ মিথ্যা মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে আপন আলয় ¯্রষ্টার কাছে অমৃতলোকে পৌঁছতে হবে।
অমৃত পৌঁছতে হলে, পরমাত্মীয়ের সান্নিধ্যে যেতে হলে, মনের কোণের শূন্যতা, দুঃখ-বেদনা ও অনন্ত তৃষ্ণা মেটাতে হলে ¯্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা একান্ত প্রয়োজন। সূচারু রূপে, একনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সংযোগ জ্ঞাপনও তাসাউফ চর্চা করা। তাসাউফ চর্চার ক্ষেত্র হচ্ছে তরীকা। তরীকা হল শরীয়তের হাকীকত দ্বারা মারিফাতে উপনীত হওয়ার সূক্ষè সম্প্রসারিত পন্থা। শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত, মারেফাতের সমন্বিত বিজ্ঞানই হল তাসাউফ। যারা এই বিজ্ঞান গবেষণায় মুখ্য উদ্দেশ্য হাসিলে সক্ষম তারাই পীর, মুর্শেদ, সূফী-আবদাল।
তাসাউফ কি! বড় পীর তাসাউফ শব্দের তাত্ত্বিক বর্ণনায় বলেন তা, ছোয়াদ, ওয়াও, ফা-এর মিলিত রূপ তাসাউফ। তবে ‘তা’ দ্বারা তাওবা, তওবা দু’প্রকার প্রকাশ্যভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও সর্বান্তকরণে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা। ‘ছোয়াদ’ থেকে ছাফা ভিতরে ও বাহিরে নিজেকে সাফ করা বা পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। ‘ওয়া’ দ্বারা বিলায়েত, বিলায়েত হচ্ছে ওলী আল্লাগণের জন্য বিশেষ মর্যাদা পূর্ণ রাজত্ব। এ তাসাউফ বা ইলমে মারোফাত ইলমে শরীয়তের মতোই অনস্বীকার্য বা অত্যাবশ্যকীয়।
ইলমে তাসাউফ : নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের দুটি দিক দিক আছে। প্রথমটি বাহ্যিক আর দ্বিতীয়টি আভ্যন্তরীণ।’ বাহ্যিক হল শরীয়ত আর আভ্যন্তরীণ হল তাসাউফ বা তরীকত ব্যবস্থা। এই জ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মোৎকর্ষ সাধন ও নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। এই জ্ঞানকে ইলমে লাদুন্নী, ইলমে মারেফত, ইলমে তরিকত, ইলমে গায়েব, ইলমে বাতেন বলা হয়।
অনুরূপ আত্মাও দু’প্রকার এক, জীবাত্মা বা নফস হিং¯্র জানোয়ারের আত্মা, পশুর আত্মা ও শয়তানের আত্মার সমষ্টি। এইটা নফস যা পাপের দিকে ধাবিত করে। দুই, মানবাত্মা ও ফেরেশতার আত্মার সমষ্টি পরমাত্মা। এই পরমাত্মাকে রূহু বলে। এই রূহের তিনটি স্বরূপ আছে যথা-মুতনাইন্না বা তৌহিদ পরিতৃপ্ত অন্তর, আম্মারাহ বা মন্দের দিকে উৎসাহদানকারী অন্তর লাওআমা বা অনুসূচনাকারী অন্তর। এর আম্মারাহ মন্দ, খারাপ অপকর্মের দিকে সর্বদা ধাবিত হয়।
তাই অন্তর আত্মাকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে তাসাউফের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্যই একটি করে শরীয়ত সম্মত জীবন ব্যবস্থা দান করেছি এবং একটি আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা দান করেছি।’ এ আয়াতের উল্লেখিত ‘মিনহাজ’ শব্দ দ্বারা তাসাউফ শিক্ষার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। হুজুর পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করার পিছনে এমন একটা সুপ্তাচরণ মনি তুল্য জ্ঞান বা খোদাপ্রেমিক আলেমগণ ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। এই বিষয়ের উপর যদি কোন খোদাতত্ত্বজ্ঞ আলেম কোন কথা বলেন, তখন বস্তুবাদী আলেমগণ তা অস্বীকার করে অমান্য করে বসেন।’ মূলতঃ শরীয়তের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে তাসাউফ। আল্লাহ পাক হযরত খিজির (আ.)-কে ইলমে বাতেন দান করেছিলেন। ‘আমি খিজিরকে ইলমে লাদুন্নী বা একটি তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি। অনুরূপ হযরত ঈসা (আ.)সম্পর্কে আমি ঈসা (আ.) কে পবিত্র রূহ (অনাবিল আত্মা) দ্বারা সাহায্য করেছি’ (আল কোরআন)।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তি পরিত্রাণ পেয়েছে যে, তার আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছে। আর সেই ধ্বংস হয়েছে, যে তার আত্মাকে অপবিত্র ও ম্লান করে দিয়েছে’Ñ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর আযিযীতে বলা হয়েছে ‘যাক্তাহা’ দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করাকেই বুঝায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন