স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যাকারী কে বা কারা । এ নিয়ে এখন চলছে নানা বিতর্ক। র্যাব বলছে, তাভেল্লার খুনীরা নব্য জেএমবি। অন্যদিকে পুলিশ তাভেল্লা হত্যাকা-ে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। র্যাব জোরালো ভাবেই দাবী করছে, জঙ্গিরা এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। তবে পুলিশ এ দাবী মানতে রাজি নয়। ফলে এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। পুলিশের চার্জশিটও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সচেতন মানুষের প্রশ্ন, তাহলে কি পুলিশ কারো মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতেই এ ধরনের চার্জশিট দিয়েছে। র্যাবের দাবী, শুধু তাভেল্লাকেই নয়, নব্য জেএমবি ব্লগার ও বিদেশী নাগরিক হত্যাসহ ২২টি হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন সময়। আর এসব হামলার একটি হলো তাভেল্লা হত্যাকা-।
গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যাকা-ের ঘটনায় বিএনপির স্থানীয় নেতাসহ সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২৭ জুন আদালতে সাত জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে থাকা আসামিরা হলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এমএ কাইয়ুম, তার ভাই আব্দুল মতিন, তামজিদ আহমেদ ওরফে রুবেল ওরফে শুটার রুবেল, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগনে রাসেল, শাখাওয়াত হোসেন শরিফ ও সোহেল ওরফে ভাঙাড়ি সোহেল।
চার্জশিট দেওয়ার প্রায় চার মাসের মাথায় র্যাব বলছে, তাভেল্লা সিজারকে গুলি করে হত্যা করে নব্য জেএমবি। নব্য জেএমবির বাংলাদেশ প্রধান সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহীম আল-হানিফের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। সারোয়ার জাহানের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া নথি বিশ্লেষণ করে র্যাব কর্মকর্তাদের দাবি, তাভেল্লা ছাড়াও নব্য জেএমবি আরও অন্তত ২২টি হামলা চালিয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যা পেয়েছি তা প্রকাশ করেছি। এখন এটা তদন্তের বিষয়। পুলিশ কি করবে বা করবে না, তা তাদের নিজস্ব বিষয়। এনিয়ে আমাদের কোনও ভাষ্য নেই।’
জানা গেছে, তাভেল্লা সিজারকে হত্যার মাধ্যমে দেশে বিদেশি নাগরিক ও ভিন্ন মতাবলম্বী ও ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা শুরু হয়। বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) দায় স্বীকার করলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব হত্যার সঙ্গে আইএস বা জঙ্গি সংগঠনগুলির সম্পৃক্ততা নেই। তবে তাভেল্লা হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের ২৬ অক্টোবর মিনহাজুল আরেফিন রাসেল, রাসেল চৌধুরী, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল এবং শাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত বছরের ৪ নভেম্বর বেনাপোল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আব্দুল মতিনকে, যিনি বিএনপি নেতা কাইয়ুমের ভাই ও স্থানীয় বিএনপি নেতা।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, তাভেল্লা সিজার হত্যাকা-ের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তামজিদ, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল ও শাখাওয়াত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মতিনসহ তারা সবাই কারাগারে রয়েছে। অভিযোগপত্রে নাম আসা বাকি দুই জন কাইয়ুম কমিশনার ও সোহেল এখনও পলাতক রয়েছেন।
তাভেল্লা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, একজন শ্বেতাঙ্গকে হত্যা করে দেশে-বিদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœœ করাই ছিল হামলাকারীদের লক্ষ্য। তাভেল্লাকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে তামজিদ। তাকে সহায়তা করে রাসেল চৌধুরী ও মিনহাজুল। মিনহাজুল মোটরসাইকেল চালিয়েছিল।
অভিযোগপত্রে এই হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে আব্দুল মতিনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মতিন ও তার ভাই কাইয়ুম কমিশনার এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা। হামলাকারীরা অস্ত্র ভাড়া নিয়েছিল ভাঙারি সোহেলের কাছ থেকে। আর মোটরসাইকেলের মালিক শাখাওয়াত। যদিও এই হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি এখনও উদ্ধার হয়নি।
অপরদিকে র্যাব বলছে, নব্য জেএমবির নেতৃত্বে তাভেল্লা ছাড়াও গত বছরের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ায় জাপানি নাগরিক ওসি কোনিও, ৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে ফাদার লুক সরকারকে হত্যা চেষ্টা, ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে পুলিশ চেকপোস্টের সময় এএসআই ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যা, ২৩ অক্টোবর তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা, ৪ নভেম্বর নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কে শিল্প পুলিশের কনস্টেবল মুকুল হত্যা, ১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে ইতালীয় ধর্মযাজক ড. পিয়েরো পারোলারি সামিওকে হত্যাচেষ্টা, ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলা, ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ চালানো হয়। এছাড়া চলতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে পুরোহিত যগেশ্বর দাসাধিকারীকে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধায় দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিক হত্যা, ৫ জুন নাটোরের বড়াইগ্রামে খ্রিস্টান পল্লীতে সুনীল গোমেজ হত্যা, ৭ জুন ঝিনাইদহের নলডাঙ্গায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে হত্যা, ১০ জুন পাবনার হেমায়েতপুরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক নিত্যরঞ্জন পান্ডে হত্যা, ১৫ জুন মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টা, ১ জুলাই ঝিনাইদহে রাধামদন মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে হত্যা, একই দিন গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারীতে হামলা ও ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মসজিদে হামলা চালানো হয় আবু ইব্রাহীম আল-হানিফের নির্দেশনায়।
বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, রংপুরের কোনিও হোসি হত্যাকা-ের ঘটনাতেও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লব এবং কোনিওর বন্ধু হুমায়ুন কবির হীরাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এদের একজনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও নেওয়া হয়। পরে জানা যায়, এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জঙ্গিরা জড়িত। গ্রেফতার হওয়া একাধিক জঙ্গি হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট ও ৪ সেপ্টেম্বর জেএমবির দুটি অপারেশন সফল হওয়ার পরে তারা একের পর এক হত্যা অপারেশন চালাতে থাকে। তারা বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার পরিকল্পনা করে। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারায় বসবাসরত বিদেশী নাগরিকদের উপর আক্রমণ করা। এছাড়া, রাফিদাদের মন্দির, হুসনি দালান, মোহাম্মদপুরে রাফিদাদের মন্দির (শিয়া মসজিদ), ঢাকার মিরপুরে ইমামবারাতে আক্রমণ করার পরিকল্পনাও করে তারা। তাদের ভাষায় তাগুতের সৈনিক অর্থাৎ র্যাব, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং ব্লগার নাস্তিকদেরকে যেখানে পাবে সেখানেই আক্রমণ করে হত্যা করা।
র্যাব জানায়, নব্য জেএমবির নথিপত্র থেকে জানা যায়, শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ ওরফে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান-২ এ ৯০ নম্বর রোডের মাথায় ইটালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কাচু আলুটারী গ্রামে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে (৬৫) গুলি করে হত্যা করে। ৫ অক্টোবর সকালে পাবনার ঈশ্বরদী পৌর এলাকার নিজ ভাড়া বাসায় ছুরিকাঘাতে ব্যাপিস্ট মিশন ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গডের ফাদার লুক সরকারকে (৫০) হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২২ অক্টোবর রাত নয়টার দিকে গাবতলী পর্বতা সিনেমা হলের সামনে পুলিশ চেক পোস্টে যানবাহন তল্লাশীকালে দারুস সালাম থানায় কর্মরত এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে (৪০) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন