বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে মায়ের সম্মান ও অধিকার

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:০৩ এএম

পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। কবির ভাষায়, ‘যেখানে দেখি যাহা, মায়ের মতো আহা, একটি কথায় এতো শুধা মেশা নাই।’ জগৎসংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্ত¦না আর স্নেহ-ভালোবাসা আমাদের সব বেদনা দূর করে দেয়, তিনি হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা একমাত্র মায়ের। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক; যা একটুখানি আঘাত পেলেই সবাই ‘মা’ বলে চিৎকার করে জানান দিয়ে থাকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে তার মা অতি মূল্যবান হয়ে থাকে। শুধু মানুষ কেনো? পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণিই তার মায়ের কাছে ঋণী। সে ঋণ শোধ করার কোনো যথাযথ উপকরণ আল্লাহতায়ালা দুনিয়ায় সৃষ্টি করেননি।

মায়ের ত্যাগের তুলনা হয় না : সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে মা-ই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। গর্ভধারণ, দুগ্ধপান, রাত জেগে সন্তানের তত্ত্বাবধানসহ নানাবিধ কষ্ট একমাত্র মা-ই সহ্য করেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণ ও দুগ্ধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয়, তখন বলে- হে আমার রব! আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার ও আমার মা-বাবার ওপর যে নেয়ামত দান করেছো, তার যেনো কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি। আমি যেনো ভালো কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে তওবা করলাম। আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আহকাফ : ১৫)।
মায়ের মর্যাদা অতুলনীয় : ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। তার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। সুতরাং আমার শোকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শোকরিয়া আদায় করো।’ (সুরা লোকমান : ১৪)।
অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকালে কবুল হজের সওয়াব : রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২১)। তাই অন্য হাদিসে এরশাদ হয়েছে, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহতায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন।’ (সুনানে বায়হাকি : ৪২১)।
বাবার তুলনায় মায়ের মর্যাদা বেশি : মা হিসেবে ইসলামে একজন নারীর অবস্থান অকল্পনীয়। ইসলামে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। পবিত্র কোরআনে মায়ের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করে মাকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। একবার এক লোক এসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার থেকে সদাচরণ পাওয়ার সর্বাধিক অধিকার কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলো। তিনি দ্বিতীয়বারও উত্তরে বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলে তিনি তৃতীয়বারের উত্তরেও বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলে রাসুল (সা.) চতুর্থবার বললেন, ‘তোমার পিতার।’ (বোখারি : ৫৬২৬)।
মায়ের মর্যাদা ছিলো অন্যান্য নবীযুগেও : নবজাতক হজরত ঈসা (আ.)-এর মুখে আল্লাহতায়ালা ভাষা ফুটিয়ে দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমি যেনো আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করি (অনুগত ও বাধ্য থাকি)। আমাকে করা হয়নি উদ্ধত অবাধ্য ও দুর্ভাগা হতভাগ্য।’ (সুরা মারিয়াম : ৩০-৩২)। বনী ইসরাইলের নবী হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতিও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বনী ইসরাইলের থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছি, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা বাকারা : ৮৩)।
মা সন্তানের সম্পদের অধিকারিনী : মা সন্তানের সম্পদের অধিকারী ও উত্তরাধিকারিনী। তার যাবতীয় ব্যয়ভার, খোরপোষ ও দেখভাল সন্তানের ওপর আবশ্যক। এরশাদ হচ্ছে, ‘মৃতের সন্তান থাকলে পিতামাতার জন্য (সন্তানের) সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশ; আর সন্তান না থাকলে পিতামাতাই ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হবে। এমতাবস্থায় মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ।’ (সুরা নিসা : ১১)।
বৃদ্ধা হয়ে গেলেও মায়ের সেবা : মা বৃদ্ধা হয়ে গেলে সাধারণত সন্তানের সেবার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় মায়ের সুবিধা-অসুবিধা ও প্রয়োজনের প্রতি খুব যত্নশীল ও দায়িত্বশীল হওয়া কর্তব্য। একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা!’ উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মাতাপিতা উভয়কে অথবা যেকোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।’ (মুসলিম : ৬২৭৯)। মায়ের সেবা করা, মায়ের যত্ন নেওয়া এবং মাকে খুশি করার গুরুত্ব বোঝাতে রাসুল (সা.) আরেক হাদিসে এরশাদ করেন, ‘জান্নাত মায়ের পদতলে।’ (কানজুল উম্মাল : ৪৫৪৩৯)।
মায়ের সেবায় সন্তানের মর্যাদা : উয়াইস আল কারনি ইয়ামেনের অধিবাসী একজন বড় মাপের তাবেঈ ও বুজুর্গ ছিলেন। তিনি ৩৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। রাসুল (সা.)-এর যুগ হওয়াসত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি তার। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিলো। তার বৃদ্ধা মা ছিলেন। মায়ের সঙ্গে তিনি সদাচরণ করতেন। মায়ের সেবাযত্ন করতেন। রাসুল (সা.) তাকে চিনতেন। হাদিসে এসেছে, হজরত উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘ইয়ামেন থেকে উয়াইস নামে এক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আসবে। ইয়ামেনে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার শ্বেত রোগ ছিলো। সে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে আল্লাহ তার রোগ ভালো করে দেন। কিন্তু তার শরীরের একটি স্থানে এক দিনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান সাদাই থেকে যায়। তোমাদের কেউ যদি তার সাক্ষাত পায়, সে যেনো তাকে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে বলে।’ (মুসলিম : ২৫৪২)।
মায়ের অবাধ্য হওয়া দ্বিতীয় বড় অপরাধ : ইসলামে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা প্রথম বড় অপরাধ; আর মাকে কষ্ট দেওয়া ও মায়ের অবাধ্য হওয়া দ্বিতীয় বড় অপরাধ। আল্লাহতায়ালা নিজের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন মাতাপিতার অধিকারের কথা। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না এবং মাতাপিতার সঙ্গে সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বোলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলো।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ২৩)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘(হে নবী, বলে দিন!) এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা পাঠ করি- তোমরা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি অনুগ্রহ করবে।’ (সুরা আনআম : ১৫২)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।’ (মুসলিম : ৪৫৮০)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Ahmad Saadi ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮:৫৬ এএম says : 0
অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই ????????
Total Reply(0)
Ahmad Saadi ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮:৫৬ এএম says : 0
অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই ????????
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন