শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

শীতে উন্মেষ ঘটুক মানবতার

উবায়দুল হক খান | প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

ঋতুর পালাবদলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় শীত। শীত এলে অনিবার্যভাবেই প্রকৃতিতে ঘটে কিছু পরিবর্তন। হেমন্তের ফসল কাটা শেষ হয়। নবান্নের সঙ্গে পিঠা-পায়েসের আয়োজন চলে গ্রামাঞ্চলে। শহরগুলোতেও এখন মৌসুমী পিঠা বিক্রেতারা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। শীত একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে, অন্যদিকে তীব্র শীত জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তোলে মানুষজনের। বিশেষ করে দরিদ্ররা শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্ট পায়। এই সময় শীতজনিত নানা রোগব্যাধিও দেখা দেয়।

তীব্র শীতে ভাসমান, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। হাসপাতালগুলোতেও বাড়ে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। এমতাবস্থায় শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শৈত্যপ্রবাহ আর ঠান্ডায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর। তারা গরম কাপড় কিনতে না পেরে খরকুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালান। ষড়ঋতুর এই দেশে একেকটি ঋতু একেক রূপ-রঙ নিয়ে হাজির হয়।
শীত মৌসুমে শিশুদের ঠান্ডাজনিত নানা রকম রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডায়রিয়া-জ্বর, হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় শিশুরা। তীব্র কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা কমে আসে। দূরপাল্ল­ার গাড়ি চলাচলও বিঘ্নিত হয়। এ জন্য বাস চলাচলে সতর্কবার্তা জারি করা উচিত। এ সময় শৈত্যপ্রবাহেরও আশঙ্কা থাকে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন হবে- এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য প্রতিটি ঋতুই যেন উপভোগ করা যায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। শীতজনিত রোগব্যাধি থেকে মানুষজনকে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া কর্তব্য। শুধু সরকার নয় সমাজের বিত্তবানরাও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সংগঠনই এ সময় পুরাতন কাপড় সংগ্রহ করে শীতার্তদের মধ্যে বিতরণ করে। এই মানবিক কর্মে যুক্ত হতে পারেন। দিতে পারেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। শীতে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। আর তখনই শীত কষ্টের ঋতু না হয়ে উৎসবের ঋতু হয়ে উঠবে।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে ধন-সম্পদ দেন না। এসব দেয়া হয় মূলত পরীক্ষার জন্য। কাউকে দিয়ে আর কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা করেন। প্রতিবছর শীত এলে দেখা যায় অনেক মানুষ শীতে কষ্ট করে মারা যায়। তারা তাদের খাবারই জোগাড় করতে পারে না। আবার শীতের পোশাক কিনবে কীভাবে। এসব মানুষদের নুন আনতে পান্না ফুরায়। এই শীতে কত কষ্ট করে গরিব মানুষগুলো ঘুমিয়ে থাকে, যা নিজে না দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই। যারা ভাতই জোগাড় করতে পারে না, তাদের আবার শীতের বস্ত্র। অনেক মানুষের শীতের বস্ত্র না থাকার কারণে আরামের ঘুমকে হারাম করতে হয়। মানুষের ঘুম হলো সবচেয়ে বড় নিয়ামত। মানবতার কল্যাণ হলো ইসলামের মহান শিক্ষা। বলা হয়- মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে মানুষের উপকারে আসে।
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো মানুষের অভাব দূর করবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার অভাব দূর করবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের কল্যাণে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তাকে সাহায্য করেন। (সহিহ মুসলিম ও তিরমিজি শরিফ)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মানুষের সেবা ও উপকারের জন্য আল্লাহ কিছু নিবেদিত প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।
মানবতার সেবায় ইসলাম : আর্তমানবতার সেবায় ইসলামের ভূমিকা সর্বাগ্রে। ইসলাম এক্ষেত্রে জোর তাগিদ ও উৎসাহ দিয়েছে। বিপদগ্রস্তের সাহায্য ও অসহায়ের সহযোগিতা করা ইসলামের মহৎ ও মৌলিক শিক্ষা। মানবতাবোধ, সহমর্মিতা, স্বার্থহীন পরোপকার ও সহানুভূতি ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও মানবজাতির পথপ্রদর্শক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির করুণাস্বরূপ পাঠিয়েছেন। আল্ল­াহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সুরা আম্বিয়া : ২১/১০৭)।
শীতার্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ইসলামের বিধান। টাকা-পয়সা, খাদ্য-বস্ত্র, পানীয় ও ঔষধ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা কর্তব্য। কারণ তাদের কাছে একেকটি দিন যেন দুর্বিষহ কষ্টের।
দানের উপমা : শীতার্ত ও অসহায়দের সেবায় প্রতিটি সামর্থবান ব্যক্তির এগিয়ে আসা উচিত। তুলনামূলক বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করার বিনিময়ে আল্ল­াহ তাআলা সর্বোচ্চ প্রতিদান দেবেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- যারা আল্ল­াহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ। প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্ল­াহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্ল­াহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারা : ২/২৬১)।
অসহায়দের সাহায্যে সাওয়াব : দারিদ্র্যক্লিষ্ট বনি আদম ও অসহায় নারীদের সাহায্য করতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্ল­াহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।
তিনি আরও বলেন- আর সে ওই নামাজ আদায়কারীর মতো যার ক্লান্তি নেই এবং ওই রোজা পালনকারীর মতো, যার রোজায় বিরাম নেই। (সহিহ বুখারি শরিফ, হাদিস : ৬০০৭)।
বিনিময় দেবেন আল্ল­াহ : শীতার্ত, অসহায়, পীড়িত, ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত ও বিপদাক্রান্ত মানুষকে সহযোগিতা করলে আল্ল­াহ উভয় জগতে প্রতিদান দেবেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে মুমিন কোনো মুমিনের ক্ষুধা নিবারণ করবে, আল্ল­াহ তাআলা তাকে কেয়ামতের দিন জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনের তৃষ্ণা দূর করবে, আল্ল­াহ তাআলা তাকে কেয়ামতের দিন মোহরাঙ্কৃত জান্নাতি সুধা থেকে পান করাবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্ল­াহ তাআলা তাকে জান্নাতের উন্নতমানের সবুজ কাপড় পরাবেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ২৩৮৬)।
মানবসেবায় ইসলামের উৎসাহ প্রদান : মানবসেবা, দুস্থদের সাহায্য ও অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইসলামের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- কেয়ামতের দিন নিশ্চয়ই আল্ল­াহ তাআলা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রষা করোনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, কীভাবে আমি আপনার শুশ্রষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার শুশ্রষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে।’
‘হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, কীভাবে আপনাকে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানো না যে, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে আজ তা পেতে?’
‘হে আদম সন্তান! তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, আপনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক, কীভাবে আপনাকে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি পান করাওনি। তাকে যদি পান করাতে, তবে নিশ্চয়ই আজ তা পেতে।’ (সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৬৭২১)।
অতএব আসুন, এই নিদারুণ শীতে মানুষের সাহায্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইসলামের নির্দেশনা মেনে মানুষের সাহায্যে তার পাশে দাঁড়াই। যথাসাধ্য সহায়তা-সহযোগিতা করে তাদের কষ্ট লাঘব করি। বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া-আখেরাতে প্রতিদান দেবেন, ইনশাআল্লাহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন