বেপরোয়া ডাম্প ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঘটনাস্থলে মারা যান আরোহী মাহমুদা আক্তার অরিন ও তার তিন বছর বয়সী শিশু কন্যা জান্নাতুল মাওয়া আতিফা। গুরুতর আহত হন অরিনের স্বামী কলেজ শিক্ষক নূর নবী পারভেজ ও অটোরিকশা চালক। গত ১৭ নভেম্বর নগরীর সিটি আউটার রিং রোডের পতেঙ্গা ধুমপাড়া অংশে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন নগরীর উত্তর কাট্টলী মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক নূর নবী পারভেজ। মুহূর্তেই আনন্দ পরিণত হয় বিষাদে।
নূর নবীর মত সিটি আউটার রিং রোডে আরও অনেকে স্বজন হারিয়েছেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই অরক্ষিত সড়কটিতে বেপরোয়া যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। তদারকির অভাবে প্রায় ২৭শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। পুলিশ বলছে, প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটিতে দ্রুতগতির ভারী যানবাহনের চাপ। এর পাশাপাশি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম এমনকি রিকশাও চলাচল করছে। আর তাতেই বাড়ছে দুর্ঘটনা।
পতেঙ্গা সৈকত ঘিরে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সড়কটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে পর্যটকরা। সেখানে নেই কোন ফুটওভার ব্রিজ, স্পিডব্রেকার। ফলে রাস্তা পারাপারের সময়ও দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন অনেকে। সড়কের পাশে জমি দখল করে দোকান-পাটের পাশাপাশি গড়ে তোলা হচ্ছে পিকনিক স্পট। বেশ কয়েকটি ট্রাক স্ট্যান্ড বানানো হচ্ছে। সড়কের অন্তত তিনটি পয়েন্টে অঘোষিত সংযোগ সড়ক চালু করা হয়েছে। এসব সড়কে গাড়ি ঘোরাতে গিয়েই ঘটছে দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেখানে লোক সমাগম ও কমগতির ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং সেইসাথে দখলবাজি বন্ধ করা না গেলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।
নগরীর পতেঙ্গা সৈকত থেকে দক্ষিণ কাট্টলী পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার আউটার রিং রোডটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। চার দফায় প্রকল্প ব্যয় তিনগুণের বেশি দুই হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়ানো হলেও কাজ এখনও শেষ হয়নি। তবে নগরীতে অব্যাহত যানবাহনের চাপ কমাতে এক বছর আগে সড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ওই সড়কের পাশেই গড়ে উঠছে চট্টগ্রাম বন্দরের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বে-টার্মিনাল। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে এ আউটার রিং রোড সংযোগ ঘটাবে প্রথম টানেলের। ফেনীর সোনাগাজী ও চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়েওঠা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের পাশ থেকে শুরু হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত উপক‚লীয় মহাসড়কের অংশ হবে এ আউটার রিং রোড। এ রোড হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর এবং পতেঙ্গা এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করছে।
সিডিএ নির্মাণ কাজ শেষ করেনি। আর এ কারণে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়নি সিটি কর্পোরেশনকে। ট্রাফিক পুলিশকেও সেখানে তেমন তৎপর দেখা যায় না। যানজটমুক্ত ছয় লেনের সড়কটিতে বেপরোয়া গতিতেই চলে সব ধরনের যানবাহন। ভারী যানবাহনের পাশাপাশি কমগতির ছোট যানবাহন চলছে অবাধে। ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন থাকলেও তা মানছেন না চালকেররা। আর এ কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত ২৪ এপ্রিল সড়কের আনন্দবাজার এলাকায় পিকআপ ও ট্রেইলরের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তাতে দুই পা হারাতে বসেছেন পিকআপ চালক মো. আরিফ। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এ যুবক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। ২৪ জুন পাথরবাহী ডাম্পারের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মো. হানিফ। তার আগে ২২ মে মুসলিমাবাদ অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৩০ মে চমেক হাসপাতালে মারা যান আবদুল মাবুদ নামে একজন। ১০ এপ্রিল বাইক আরোহী বেপজা স্কুলের ছাত্র সজীব উদ্দিন তৌহিদ ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান। ৫ ফেব্রæয়ারি ট্রাকের ধাক্কায় মারা যান ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা।
পুলিশ বলছে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে বিকেল থেকে সন্ধ্যায়। কারণ দুপুরের পর সড়কটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন পর্যটকেরা। অটোরিকশা, প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যায়। অথচ সড়কটিতে ভারী যানবাহন তথা কন্টেইনারবাহী লরি, প্রাইমমুভার, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, জ্বালানি তেলবাহী লরি চলাচল করে। সড়কবাতি না থাকায় সন্ধ্যার পর নেমে আসে অন্ধকার। তাছাড়া বাইকারদের বেপরোয়া রেইসের কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ককে ঘিরে এমন চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (্ট্রাফিক-পশ্চিম) মো. তারেক আহম্মদ বলেন, সড়কটি নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। এই কারণে সড়কে বাতি নেই, নেই স্পিডব্রেকারও। পথচারী পারাপারেরও কোন ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া সড়কের কয়েকটি অংশে অবৈধ কিছু সংযোগ সড়ক দিয়ে গাড়ি উঠানামা করছে। এসব কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।
তিনি বলেন, নগরীর প্রধান সড়কের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত অংশে চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। পোর্ট কানেকটিং রোডের সংস্কার কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এই কারণে এই সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি। এই সুযোগে টমটম, ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো ছোট গাড়িও চলাচল করছে। তবে ট্রাফিক পুলিশ এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, পতেঙ্গা সৈতককে ঘিরে সড়কের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা হয়েছে। এখন সড়কে কোন ভারী যানবাহন রাখা হচ্ছে না। সড়কের পাশে কয়েকটি এলাকায় গড়ে উঠা অবৈধ স্ট্যান্ডও সরিয়ে দেওয়া হবে। সড়কটিতে দ্রæতগতির যানবাহনের সাথে ছোট গাড়ি চলাচল করায় দুর্ঘটনা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করছি।
সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজি হাসান বিন শামস বলেন, সড়কে আশপাশে কোন অবৈধ স্থাপনা থাকবে না। অবৈধ কোন সংযোগ সড়কও করতে দেয়া হবে না। পতেঙ্গা সৈকতের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে আউটার রিং রোডের নিচে ইপিজেডের উত্তর এবং ইপিজেডের দক্ষিণ পাশে দুই লেনের একটি সার্ভিস লেন নির্মাণ করছি। ওই রোড দিয়ে লোকাল ও পর্যটকদের গাড়ি চলাচল করবে। এমনিতে সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি।
টানেল চালু হলে চাপ আরো বাড়বে। পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় ২০ হাজার যানবাহন রাখার মতো দুটি পার্কিং প্লেস নির্মাণ করা হবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পতেঙ্গায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ছাড়া কোন রকম স্থাপনা থাকবে না। আগামী বছরের শুরুতে রিং রোডের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, হাইওয়ের অংশ হওয়ায় মূল সড়কে কোন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। তবে জংশন পয়েন্ট আর পতেঙ্গা সৈকত পয়েন্টে বিদ্যুৎ থাকবে। অঘোষিত সংযোগ সড়কের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব সড়কের কোন অনুমোদন দেয়া হয়নি। আমরা সার্ভিস রোড করব, ওই সার্ভিস রোডের মাধ্যমে মূল রোডে আসতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন