দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ যেন কেতাবের হিসাব। প্রবাদের ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে- দেশে বর্তমানে চালের উৎপাদনের পরিমাণ তিন কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টন বছরে। প্রতিজনের ৩৭৫ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হলে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ মিলিয়ন (দুই কোটি ৮০ লাখ) টনের মতো। সে হিসাবে তো ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন চাল উদ্ধৃত থাকার কথা। অথচ প্রতিবছর বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় বিশ্বে চাল আমদানি করা দেশগুলোর মধ্যে চীনের পরেই অবস্থান বাংলাদেশের। অবশ্য দেড়শ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি ফারাক প্রায় দ্বিগুণ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) চলতি মাসের ‘খাদ্যশস্য : বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, চাল আমদানিতে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে থাকা চীন প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৫ লাখ টন চাল আমদানি করে থাকে। অন্যদিকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ফিলিপাইন প্রতি বছর ২৬ লাখ টন চাল আমদানি করে। চতুর্থ অবস্থানে থাকা নাইজেরিয়ার আমদানি পরিমাণ ১৯ লাখ টন এবং পঞ্চম অবস্থানে থাকা সউদী আরব প্রতি বছর ১৩ লাখ টন চাল আমদানি করে।
সম্প্রতি ইউএসডিএ’র প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ এখন বড় আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের আমদানি ধারাবাহিক নয়। মানে হলো, কোনো বছর উৎপাদন কম হলে বাংলাদেশ চাল আমদানি করে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ সময়ে চাল উৎপাদন আগের পূর্বাভাসের তুলনায় সাড়ে ৭ লাখ টন কম হতে পারে। উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টন। অন্যদিকে বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে মোটা চাল খুচরা পর্যায়ে কেজি ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের দাম কেজি ৬৬ থেকে ৭০ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি চাল কেজি ৫২ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
আমদানি মূল্যের তালিকা দিতে গিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি মোটা চালের দাম পড়ছে ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, পাকিস্তানে ৩৪ টাকা, ভিয়েতনামে ৩৮ টাকা এবং থাইল্যান্ডে ৪০ টাকা।
চলতি বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘বাংলাদেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ বৃদ্ধিকরণ-ডিআরপি’ শীর্ষক বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কৌশলপত্র উপস্থাপন করা হয়।
মূল প্রবন্ধে ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীর জানান, দেশের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদন বাড়াতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বর্তমানে দেশে (২০২০-২১ অর্থবছর) চাল উৎপাদনের পরিমাণ তিন কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০৩০ সালে চার কোটি ৬৯ লাখ, ২০৪০ সালে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০৫০ সালে ছয় কোটি আট লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব। ব্রি’র ৪০ জন গবেষকের দুই বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় ‘বাংলাদেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ বৃদ্ধিকরণ-ডিআরপি’ শীর্ষক কৌশলপত্রটি তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধে ব্রি’র মহাপরিচালক বলেন, ডাবলিং রাইস প্রোডাক্টিভিটি-ডিআরপি একটি সমন্বিত মডেল, যেখানে ধানের ফলন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে, অনাবাদি ও পতিত জমি চাষের আওতায় আসবে, ব্যাপক হারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ঘটবে, ধানের গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে, ধান ও চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে এবং ধান উৎপাদনে ঝুঁকি কমাবে।
অথচ গত আগস্ট মাসেও দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বেসরকারি ৭১ প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। এর আগে ১২ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর আগে গত বছর চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশে নামানো হয়, যার মেয়াদ গত এপ্রিলে শেষ হয়েছিল।
মূলত বর্তমান বাজারে চালের দাম হু হু করে বেড়েই চলছে। চালকল মালিক, মজুতদার ও কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ ৫ বছর আগে সরকার চালকল মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে সারা দেশের অন্তত ১৫ হাজার মিলকলের ‘কালো তালিকা’ করেছিল। ওইসব মিলের মালিকদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ বছরেও বাজারে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ হয়নি। হঠাৎ হঠাৎ চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফাখোর সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকা নিয়ে যায়। বাধ্য হয়েই সরকারকে বিদেশ থেকে চাল ক্রয় করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে চাল আমদানি দোষের কিছু নেই। কিন্তু দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এমন তথ্য প্রচার করা হচ্ছে কেন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন