হাফেজ সাইফুল ইসলাম
তাহাজ্জুদ শব্দটি নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া পরস্পরবিরোধী দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে ‘রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন’ (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭৯)। কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকার অর্থ নামাজ পড়া। এ কারণেই রাত্রিকালীন নামাজকেই তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। তবে অধিকাংশ মুফাসিসরগণের মতে, শয্যা পরিত্যাগ করে যিকির ও দোয়ায় আত্মনিয়োগ করার অর্থ তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজ, যা গভীর রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর পড়া হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। ইসলামের সূচনার যুগে এটি মহানবী (স.) ও উম্মত সবার জন্য ফরজ ছিল।
রাসূল (স.)-এর মে’রাজের পর তা নফল হয়ে যায়। যেমন সূরা মুজ্জাম্মিলের শুরুতে আল্লাহপাক আদেশ দিয়েছেন ‘হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রিতে দ-ায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে অর্ধ রাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত ১-৩)। এই আয়াতসমূহে তাহাজ্জুদের নামাজ কেবল ফরজ করা হয়নি বরং রাত্রির চতুর্থাংশ নামাজে মশগুল থাকার প্রতিও তাগিদ দেয়া হয়েছে।ইমাম বাগবী (রহ.) বলেন, এই আদেশ পালনার্থে রাসূল (স.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ অধিকাংশ রাত্রি তাহাজ্জুদ নামাজে ব্যয় করতেন। ফলে তাদের পদদ্বয় ফুলে যায় এবং আদেশটি কষ্টসাধ্য প্রতীয়মান হয়। পূর্ণ এক বছর পর ওই সূরার শেষাংশের ‘কোরআনের যতটুকু তোমাদের সহজ মনে হয় ততটুকু আবৃত্তি কর’ আয়াতটি নাজিল হলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায় এবং বিষয়টি নিজের ইচ্ছর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যতক্ষন নামাজ পড়া সহজ মনে হয় ততক্ষণ নামাজ পড়া তাহাজ্জুদের জন্য যথেষ্ট। হজরত ইবনে আব্বাস (র.) বলেন, মে’রাজের রাত্রিতে পঞ্জেগানা নামাজ ফরজ হওয়ার আদেশ এলে তাহাজ্জুদের ফরজের আদেশটি রহিত হয়ে যায়।তবে এরপরও তাহাজ্জুদ সুন্নাত হিসেবে বহাল থেকে যায়। কারণ রাসূল (স.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ নিয়মিতভাবে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। (তাফসিরে মা’আরিফুল কোরআন, ক্বিয়ামুল লাইল)।
তাহাজ্জুদের মর্যাদা অপরিসীম। ফরজ নামাজের পরে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। হাদিস শরীফে রাসূল (স.) এরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর উত্তম রোজা হলো মুহাররম মাসের রোজা এবং ফরজ নামাযের পর উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ’ (তাহাজ্জুদের নামাজ)। তাহাজ্জুদগুজার বান্দাহ্দের অগ্রগতির স্বীকৃতি আল্লাহপাক স্বয়ং নিজেই দিয়েছেন যথা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সেজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে এবাদত করে, পরকালের আশঙ্কা রাখে এবং তার পালন কর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান? যে এরূপ করে না’ (সূরা জুমার, আয়াত নং-৯)। বেহেশতবাসী পরহেজগার মুমিন বান্দাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা রাত্রির শেষাংশে জাগ্রত থেকে নামাজ পড়ে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ তা’আলা তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, ‘তারা (খোদাভীরুরা) রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (সূরা আজ-জারিয়াত, আয়াত-১৭-১৮)।
মহান প্রভু পবিত্র কোরআনের সূরা ফুরকানে তাঁর প্রিয় বান্দাহ্দের ১৩টি বিশেষ গুণাবলী ও আলামত বর্ণনা করেছেন। সেই বিশেষ গুণসমূহের একটি হচ্ছেÑ তাহাজ্জুদ নামাজ। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দ-ায়মান হয়ে।’ (সূরা আল- ফুরকান, আয়াত-৬৪)।
কেয়ামতের ভয়াবহ বিপর্যয় ও কঠিন হিসাব-নিকাশের দিবসে কোন ব্যক্তি যদি সহজ হিসাব কামনা করে, তবে তার উচিত হবে নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া। শ্রেষ্ঠতম মুফাসিসরে কোরআন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (র.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হাশরের ময়দানে সহজ হিসাব কামনা করে, তার উচিত হবে আল্লাহ যেন তাকে রাত্রির অন্ধকারে সেজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় পান। তার মধ্যে পরকালের চিন্তা ও রহমতের প্রত্যাশাও থাকা দরকার। (তাফসিরে কুরতুবি, মা’আরেফুল কোরআন, ক্বিয়ামুল লাইল)।
মহান আল্লাহ তা’আলা তাহাজ্জুদগুজার বান্দাহ্দের জন্য জান্নাতে অসাধারণ বালাখানা সজ্জিত করেছেন। হজরত আবু মালেক আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (স.) বলেন, ‘জান্নাতে এমন কক্ষ থাকবে যার ভিতরের অংশ বাহির থেকে এবং বাইরের অংশ ভিতর থেকে দৃষ্টিগোচর হবে।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.) এসব কক্ষ কাদের জন্য? উত্তরে রাসূল (স.) বললেন, যে ব্যক্তি সালাম করে, ক্ষুধার্তকে আহার করায় এবং রাত্রে যখন সবাই নিদ্রিত থাকে, তখন সে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী তিরমিজি ) (তাফসিরে মাজহারি, মা’আরেফুল কোরআন)।
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত রোজ হাশরে সমগ্র সৃষ্টিকুলের উপস্থিতিতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী প্রিয় বান্দাহদের মহান সম্মানে ভূষিত করবেন। হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ হতে বর্ণিত আছে যে, ‘রাসূল (স.) এরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন যখন আল্লাহ পাক পূর্ববর্তী মানবম-লীকে একত্রিত করবেন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আহ্বানকারী (যার আওয়াজ সমগ্র সৃষ্টিকুল শুনতে পাবে) দাঁড়িয়ে আহ্বান করবেনÑ হে হাশরের মাঠে সমবেত মানবম-লী, আজ তোমরা জানতে পারবে যে, আল্লাহপাকের নিকট সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী কে? অনন্তর সে ফেরেশতা ‘যাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকে’ এরূপ গুণের অধিকারী লোকগণকে দাঁড়াতে আহ্বান জানাবেন। এই আওয়াজ শুনে এসব লোক (তাহাজ্জুদগুজার) দাঁড়িয়ে পড়বেন, যাদের সংখ্যা হবে খুবই নগণ্য। এদের হিসাব গ্রহণ ব্যতিতই বেহেশতে প্রেরণ করা হবে। অতঃপর অন্যান্য সমগ্র লোক দাঁড়াবে এবং তাদের হিসাব গ্রহণ করা হবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, মাজহারি, মা’আরিফুল কোরআন)।
তাহাজ্জুদ নামাজ; মন্দ কাজের কাফফারা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মহান সুযোগ। তিরমিযি শরীফে হজরত আবু উমামা বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (স.) এরশাদ করেছেন, নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সব নেক বান্দাহর অভ্যাস ছিল। এটা তোমাদেরকে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যদানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং গুনাহ থেকে নিবৃত্তকারী। (মাজহারি, মাআরেফুল কোরআন)।
প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি কামনা করেন, আল্লাহ যেন তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন, তার এবাদত-বন্দেগি কবুল করেন এবং তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেন। এসব চাওয়া-পাওয়ার প্রধান অবলম্বন হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। সহিহ হাদিসের সবকটি কিতাবেই এই হাদিসটি বর্ণিত আছে যে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত রাসূল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আকাশে বিরাজমান হন এবং ঘোষণা দেন যে, কোনো প্রার্থনাকারী আছ কি? যার প্রার্থনা আমি কবুল করব। প্রয়োজন প্রার্থনার কোনো লোক আছ কি? যার প্রয়োজন আমি পূর্ণ করে দেব। এবং কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? যাকে আমি ক্ষমা করে দেব।’
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে আরো অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে কারিমা ও হাদিস শরীফ রয়েছে যা সীমিত পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। উক্ত আয়াত ও হাদিস শরীফসমূহ থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে, তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথনের এক মহান অবলম্বন। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। তাহাজ্জুদের বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়।
লেখক : প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক,
রামু লেখক ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন