শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

যাপিত দিনরাত ও ইসলামের বার্তা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

বর্তমানে সৎকাজ, পরোপকারিতা, কল্যাণ কামনা, ইবাদত-বন্দেগি ও আখেরাতমুখিতা চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যায়-পাপাচার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকটভাবে অনুপ্রবেশ করছে। পার্থিব লোভ-লালসা, শোভা-সৌন্দর্য ও ভালোবাসা মানুষকে আখেরাত থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ রেখেছে। পঙ্গপালের মতো পার্থিব সম্পদ ও যশ-খ্যাতি উপার্জনের দিকে অনেকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ পরকালকে পেছনে ফেলে দুনিয়ার ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া সমস্ত গোনাহের মূল। কেবল ইবাদত তথা গোলামি করার জন্যই আল্লাহতায়ালা বান্দাকে অতি যত্নে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর পরিচয় লাভ করে নৈকট্য অর্জনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ভয়মিশ্রিত ভক্তি-শ্রদ্ধা আর মন-প্রাণ উজাড় করা প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে তাঁর পথে বারবার ফিরে আসার জন্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর এই লক্ষ্য থেকে দূরে বা এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ, তাদেরকে তিনি সতর্ক করেছেন, ‘অধিক সম্পদ লাভের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে গাফেল করে রেখেছে। এমনিভাবেই তোমরা (ধীরে ধীরে) কবরে হাজির হবে। এমনটি কখনও নয়, তোমরা অতিসত্বরই (এর পরিণাম) জানতে পারবে। (কতো ভালো হতো!) যদি তোমরা সঠিক জ্ঞান সম্বন্ধে জানতে! অবশ্যই তোমরা (সেদিন) জাহান্নাম দেখতে পাবে। অতঃপর তোমরা অবশ্যই তোমাদের নিজ চোখে তা দেখতে পাবে। অতঃপর (তাঁর অগণিত) নেয়ামত সম্পর্কে সেদিন তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
আখেরাতের অনন্ত জীবনের প্রতি উদাসীনতা ও অমনোযোগিতায় আমরা অটল। ফলে আমাদের প্রকৃত ঠিকানা জান্নাত থেকে ক্রমেই দূর থেকে দূরে ছিটকে পড়ছি। যেনো এই বিরাগতা ছেড়ে আখেরাতের প্রতি উৎসাহী ও মনোযোগী হই, সে লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘কিন্তু তোমরা তো সর্বদাই দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকো। অথচ আখেরাতের জীবনই হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।’ (সুরা আলা : ১৬-১৭)। বিবেকবান মুমিন কখনও অস্থায়ী, তুচ্ছ ও মূল্যহীন বস্তুকে স্থায়ী ও মহামূল্যবান বস্তুর ওপর প্রাধান্য দিতে পারে না। এতোসব ব্যস্ততা আর উদাসীনতার ফলেই আমরা মহান রবের যথার্থ ইবাদত-বন্দেগি ও গোলামি ত্যাগ করছি। অথচ রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে তার জন্মগ্রহণের মুহূর্ত হতে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে মৃত্যু পর্যন্তও সেজদায় পড়ে থাকে, এরপরও কেয়ামত দিবসে সে এটাকে খুবই নগণ্য মনে করবে। তখন সে আশা করবে, যেনো তাকে আবার দুনিয়ায় পাঠানো হয়। যাতে (আরও বেশি পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে নিজের) প্রতিদান ও সওয়াব বাড়াতে পারে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৩২১)।
পরকালের প্রতি উদাসীনতা ও আল্লাহবিমুখতার ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা আরও ব্যাপক। তারা ইবাদত-বন্দেগিতে সীমাহীন গাফেল। শয়তান তাদেরকে ক্ষণস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শোভা-সৌন্দর্য, সৌখিনতা ও বিলাসিতার পূজারি বানিয়ে স্থায়ী নিবাস জান্নাত ও তার নেয়ামত লাভের আমল থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অথচ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। তবে তাদের অন্তর সত্য অনুধাবনে পুরুষ অপেক্ষা অধিক নরম, উর্বর ও কোমল। তাই ইমান-আমল থেকে তাদের যতোটুকু পদস্খলন, তা কেবল উদাসীনতা ও শয়তানের প্ররোচনায়। হে বোনেরা! তোমরা মুসলিম নারী। ইসলাম তোমাদের ধর্ম। ইমান তোমাদের গর্ব। হৃদয় তোমাদের ইমানের জ্যোতিতে পূর্ণ। পাপ-পঙ্কিলতা আর উদাসীনতা তোমাদের হৃদয়মুকুরের সেই আলোক প্রদীপকে ম্লান করে রেখেছে। সে প্রদীপের পূর্ণ দীপ্তির বিচ্ছুরণের জন্য প্রয়োজন এক টুকরো পরশ পাথর। এতে তোমরা ফিরে পাবে তোমাদের হৃদয়রাজ্যের আলোক-ঝলমলতা। যা দেখাবে তোমাদেরকে জান্নাতের রাজপথ। কেটে যাবে সব অমানিশার আঁধার। হবে তখন সত্যিকারের মুমিন-মুসলমান। যা আমাদের সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। একটিবার ফিরে এসো হে বোনেরা! আন্তরিকতার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো পরম দয়ালু আল্লাহর আনুগত্য ও গোলামির রজ্জুকে। যেনো জীবনের বাকি সময়টুকু তোমাদের অতিবাহিত হয় সৎ ও সততার পথে। যে লক্ষ্যে তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তাতে তুমি একনিষ্ঠভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারো; আর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমৃত্যু তাঁর এ বাণী প্রতিফলিত হয়, ‘হে নবী! আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণÑ সবই রাব্বুল আলামিনের জন্য।’ (সুরা আনআম : ১৬২)।
হে যুবকেরা! তোমাদেরকে আয়-উপার্জন ছেড়ে দিতে বলছি না। এ-ও বলছি না, আয়-উপার্জন করা ইসলাম সমর্থিত নয়; বরং হালাল উপার্জনও একটি উত্তম ইবাদত। যা-ই উপার্জন করো, তা যেনো শরিয়ত সমর্থিত সঠিক পদ্ধতিতে হয়। পার্থিব সম্পদ উপার্জনের লোভ ও ব্যস্ততা যেনো কখনও তাড়িয়ে না বেড়ায়। এ ক্ষেত্রে সর্ব শীর্ষে রাখতে হবে নিজেদের দীন-ইমান। কুপির সলিতা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তা থেকে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। চতুর্পাশ কালো হয়ে যায়। অসতর্কতার ফলে কখনও তো এ ধরনের বাতি থেকে ঘর-বাড়ি পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। সুতরাং সুন্দর আলো ও নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য কুপির সলিতা যেমন স্বাভাবিক ও নিয়মমাফিক হওয়া জরুরি, তদ্রুপ দুনিয়া উপার্জনটা হতে হবে নিয়মমাফিক। যেনো দুনিয়া আখেরাতের বিধ্বংসী না হয়। মেশকাত শরিফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মেরকাত’-এ আছে, ‘দুনিয়ার শোভা-সৌন্দর্য দুনিয়া উপার্জনকারীর বিবেচনাতেই হয়ে থাকে। দুনিয়ার মালিক আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তির উপার্জিত দুনিয়া ওই চর্বির মতো, যা দেখতে মনোলোভা, কিন্তু ভেতরে বিষমিশ্রিত; আর ওই দিরহামের মতো, যা দেখতে রুপার মতো চকচকে, কিন্তু ভেতরে চিন্তার পাহাড় লুকায়িত; আর ওই দিনারের মতো, যা দেখতে সোনার মতো ঝকঝকে, কিন্তু ভেতরে আগুন লুকায়িত। বোধহীন-পাগল ও মৃগী রোগী যেমন ক্ষতের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে না, উল্লিখিত দুনিয়া উপার্জনকারীরাও পার্থিব সম্পদ দিনার-দিরহামের ক্ষতি স্বাভাবিকভাবে বুঝতে পারে না।’ কবি চমৎকার বলেছেন, ‘তুমি ঘোড়ায় আরোহী না গাধায়Ñ শীঘ্রই দেখতে পাবে, যখন ধুম্রজাল ছিন্ন হবে।’
আজকাল দুনিয়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ ও নিমগ্নতা বেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে গোলামি ও আনুগত্যের জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার প্রতি ব্যাপক উদাসীনতা ও অমনোযোগিতা দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ একবার রাসুল (সা.) একটি কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কবরটি কার?’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘অমুক ব্যক্তির।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘এই কবরবাসীর কাছে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা তোমাদের দুনিয়ার বাকি সমস্ত জিনিস অপেক্ষা অধিক প্রিয়।’ এ হচ্ছে আমাদের দুনিয়া ও দুনিয়ার ভোগ্যসামগ্রীর মূল্য। যা লাভের আশায় আমরা পরকালকে ভুলে পরস্পরে খুনোখুনি ও পাপাচারে ডুবে আছি। যখন আমাদের সব খেলা শেষ হবে, শরীরের শক্তি ফুরিয়ে যাবে, রক্তকণিকা পানি হয়ে যাবে, চিরতরে চোখদুটো বুজে যাবে, প্রাণপাখি উড়ে যাবে এবং নতুন জগতের সূচনা হবে, তখন মাত্র দু’রাকাত নামাজের সওয়াবের জন্য আফসোস করতে হবে। কিন্তু সে আফসোসে কোনো লাভ হবে না। চোখের জলে কারও অন্তরে মায়া হবে না। অথচ দু’রাকাত নামাজ আদায় করার মতো পর্যাপ্ত সময় আমাদের হাতে আছে। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায়, অনর্থক গল্পগুজবে সময় নষ্ট করছি। এরশাদ হচ্ছে, ‘যা কিছু ভালো ও উত্তম কাজ, তোমরা আগেভাগেই নিজেদের জন্য আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে রাখবে, তা-ই তোমরা তাঁর কাছে (সংরক্ষিত দেখতে) পাবে; পুরস্কার ও এর বর্ধিত পরিমাণ হিসেবে তা হবে অতি উত্তম।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ২০)।
পার্থিব জীবনের অণু পরিমাণ নেক আমলের প্রতিদানও পরকালে বাদ যাবে না; বরং সেটাকে পার্থিব জীবনের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি করে চিরস্থায়ী নিবাস তথা জান্নাতে দেওয়া হবে। পার্থিব জগতের সমস্ত ভালো ও কল্যাণই পরলৌকিক অর্জিত ফসল এবং তার বীজ, কাণ্ড ও শেকড়। ওই সমস্ত সময়ের ওপর আফসোস, যা অতিবাহিত হয়েছে কেবল উদাসীনতা ও রিপুর কামনা-বাসনা পূরণে। ওই সময়ের ওপর দুঃখ, যা নিঃশেষ হয়েছে ইবাদত ও নেক আমলমুক্ত অবস্থায়। এমন অন্তরের প্রতি পরিতাপ, সৃষ্টিকর্তার বাণীসমূহ যার মাঝে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। আল্লামা ইবনুল জাওজি (রহ.) ব্যথাতুর হৃদয়ে আকুতি করেছিলেন, ‘কতোই না ভাগ্যবান ওইসব ব্যক্তি, যাঁরা নিদ্রার স্বাদ উপেক্ষা করে রাত্রি জাগরণকে আপন করে নিয়েছেন। যাঁরা একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে সালাত আদায়ের জন্য বেছে নিয়েছেন রাতের আঁধারকে। যাঁরা দীর্ঘক্ষণ সালাতে দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন অম্লান বদনে। যাঁরা প্রতিপালক কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিদান লাভে প্রার্থনা করেন চোখের জল ফেলে। যাঁরা নিজের কোনো দোষ-ত্রুটি নজরে এলেই তওবা-ইস্তেগফারে ব্রতী হন অনুতপ্ত মনে।’ (আল ইয়াওকিতুল জাওজিয়্যাহ : ২৮-২৯)।
সুস্থতা ও অবসরতাকে মূল্যায়ন করা উচিত। জীবনের বাকি সময়টুকু আপন প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করা চাই। যেনো ইবাদতের ত্রুটির কারণে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে লজ্জিত হতে না হয়। যারা ইবাদত করে, তাদের জন্য কৃত ইবাদতকে কখনও যথেষ্ঠ মনে না করা চাই। কেননা রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে জন্ম থেকে নিয়ে বাধর্ক্যে উপনীত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত চেহারার ওপর হেঁচড়ে চলে, সে কেয়ামতের দিন এটাকেও তুচ্ছ মনে করবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৩২০)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন