ধৈর্য মনুষ্যত্বের অন্যতম পরিচায়ক। ধৈর্য হলো নফসের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা। ইহজগতে এমন কোনো কাজ নেই যা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ছাড়া সমাধান করা যেতে পারে। তাছাড়া একজন মুমিন ব্যক্তির জীবনের সব ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করা এটিই ইসলামের শিক্ষা। ধৈর্য এর আরবি প্রতিশব্দ সবর'। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সহিষ্ণুতার সাথে আল্লাহর বিধান মোতাবেক সকল কর্তব্য পালন করাকে ধৈর্য বলে। ধৈর্যকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১. অবৈধ ও হারাম বস্তু থেকে নিজের নফস্ বা প্রবৃত্তিকে বিরত রাখতে ধৈর্যধারণ করা। ২. আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্য ধৈর্যধারণ করা। ৩. যেকোনো বিপদ আপদে ধৈর্য রাখা।
ধৈর্যের প্রকার : অনেকে মনে করেন ধৈর্য ধারণ করা শুধুমাত্র কষ্ট ও বিপদের সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং সত্য ও সঠিক পথে চলার ধারা বজায় রাখতে সবরের প্রয়োজনীয়তা আরো অধিক। ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তাকদীর। একজন মুমিনকে তাকদিরের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। ধৈর্যের প্রকার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। যথা: প্রথম - আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। এটি ওয়াজিব ধৈর্যধারণ। দ্বিতীয় - আল্লাহ তাআলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। তৃতীয় - তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য্য ধরা।
ধৈর্যের গুরুত্ব : ধৈর্য মানবজীবনের মহৎ একটি গুণ। এটি মানবজীবনের সফলতার চাবিকাঠি। ধৈর্যের অনুশীলন ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য আনা যায় না। ধৈর্য ধারণ করা খুবই কঠিন কাজ তথাপি সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য তা করা আবশ্যক। সমাজ জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণময় জীবনযাপনের জন্য ধৈর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ সুবহানাল্লাহ ওয়া তায়ালা ধৈর্য কারীদের বলেন, বলুন, হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত। (সূরা আয যুমার - ১০)
মানুষের জীবনে সুখ-দু:খ, বিপদ-আপদ, সফলতা-বিফলতা, ভয়-পরাজয় থাকবেই। একজন মুমিনকে অবশ্যই সুদিনের জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তেমনি সুখশান্তি প্রাপ্তিতেও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। ধৈর্যের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এবং দুনিয়া ও আখিরাতের উপকারিতাগুলো দেখলে এটি ভালভাবে বোঝা যায় যে পবিত্র কুরআনে বহুবার আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ধারণ করার আদেশ দিয়েছেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন নমরুদের মূর্তি পূজার বিরোধিতা করলো, তখন নমরুদ তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল। তিনি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্যে চান নি। হযরত ইউসুফ (আ.) যখন জুলেখার ষড়যন্ত্রে আটকে গেলেন তখন তিনি একমাত্র তার রবের নিকট প্রার্থনা করেছিলেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারে অটল, মক্কার বিধর্মীরা তখন দেখল যে প্রলোভন, ভীতি ও অকথ্য নির্যাতন তথা কোনো কিছুর মাধ্যমেই তাকে দমন করা যাচ্ছে না, বরং ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে সামাজিকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলো। অত : পর তারা মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীদের সঙ্গে ওঠা-বসা, বেচাকেনা, লেনদেন এমনকি খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরোধ আরোপ করলো। এ ধরনের দুর্দিনেও রাসূল (সা.) ধৈর্য হারাননি, বরং তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব সহ্য করে গেলেন। পরবর্তী কুরাইশরা নিজেদের ভুল বুঝে তাদের বর্জননীতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
শরিয়তের বিধান পালন করতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, রমজান মাসের সিয়াম পালন, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হজ পালন, সম্পদ অর্জনের সাথে যাকাত প্রদান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। ধৈর্যশক্তি বাড়ানোর আরেকটি উপায় উল্লেখ করলে তা হলো- অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা। যে কোনো বিষয় আপনার ভাবনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী না-ও এগোতে পারে। আপনার প্রত্যাশা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। ধৈর্য ও সাফল্য-একটির সঙ্গে আরেকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মূলত মানুষ অতীত নিয়ে দু : খিত, ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বর্তমান নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলা যাকে এই গুণ দেন; সেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। আল্লাহ তা’আলা নবী-রাসূল কে এই বিরল গুণে বিভূষিত করেছিলেন।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে ধৈর্যধারণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সকল বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করব। বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করব। আমরা ধৈর্যশীল হবো।
ধৈর্যের ফল : ধৈর্য হচ্ছে মানুষের এমন একটা গুন,যার কারণে সে অসুন্দর ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি অন্তর্গত শক্তি, যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
ধৈর্য বা সবরের ফল দুনিয়ার মধ্যেও পাওয়া যায়, আখেরাতেও পাওয়া যাবে। ধৈর্য ধরার উপকরিতা অনেক। আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে।’
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধেক অংশ। আলহামদুলিল্লাহ (শব্দ) পাল্লাকে ভরে দেয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন