পহেলা পৌষ কনকনে শীত। রাত দেড়টা। হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন শত শত যাত্রী ও তাদের স্বজনরা। হীমশীতে মশার কামড়ে অতিষ্ট সবাই। শুধু তাই নয়, ফ্লাইট শিডিউলে বিপর্যয়, করোনা টেস্টের জন্য দীর্ঘ লাইন, স্বল্পসময়ে অধিক ফ্লাইট ওঠানামা, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, যাত্রীদের স্ক্যান করার পরও কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনে আলাদাভাবে তল্লাশি, লাগেজ পেতে বিড়ম্বনা, পার্কিং বিড়ম্বনা, দালালের উৎপাতসহ নানা অভিযোগ যাত্রীদের। গত কয়েক দিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সরেজমিন ঘুরে ও যাত্রীদের সাথে কথা বলে এমন ভয়াবহ ভোগান্তির কথা জানা যায়। তবে এই ভোগান্তির শেষ কোথায় তা বলতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।
একই দিন ১টা ৫০ মিনিটের দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশ পথে ২ জন এপিবিএন সদস্য নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত আছেন। কিন্তু বাইরে প্রায় শত মানুষ অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ করোনা টেস্টের নমুনা দেয়ার জন্য নির্ধারিত স্থান খুঁজছেন। কিন্তু তাদের সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দুই সদস্যের সাথে কথা বলেও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। তাই অনেককেই এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতেও দেখা গেছে।
জানা যায়, যাত্রা শুরুর ছয় ঘণ্টা আগে প্রবাসী এবং বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা শনাক্তে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দ্বিতীয় তলায় আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা যাত্রীদের ওই ল্যাব খুঁজে পেতেও বেগ পেতে হয়।
এরপর রাত ২টায় বিমানবন্দরের দ্বিতীয় তলায় আরটি-পিসিআর ল্যাবে গিয়ে দেখা গেছে, ল্যাবের বাইরে মেঝেতে যাত্রী ও তাদের স্বজনরা শুয়ে আছেন। এছাড়াও ল্যাবের ভেতরে যাত্রীদের একাধিক লম্বা লাইন রয়েছে। সেখানে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কে দুইজন কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা যাত্রীদের ফরম দিচ্ছেন। তবে হেলথ ডেস্কে কেউ নেই। তাই সেই ডেস্কের সামনে দীর্ঘ লাইন রয়েছে। কেউ কেউ লাইনে না দাঁড়িয়ে ল্যাবের ভেতরের শুয়ে ও বসে আছেন। এক পর্যায়ে কথা হয় মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার বাসিন্দা পারভেজ আলীর সাথে। তিনি বলেন, আমার ফ্লাইট রাত ১টায় ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরে ফ্লাইট উঠানামা বন্ধ হওয়ার কারণে পরদিন সকালে ফ্লাইট হবে। এ জন্য আগের দিন সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু রাতে নির্ধারিত সময়ে ল্যাবে আসলেও নির্ধারিত সময়ে নমুনা দিতে পারিনি। এছাড়াও একই সাথে মশার যন্ত্রনায় অতিষ্ট। এছাড়া আরটি-পিসিআর ল্যাবের ভেতরে ভিআইপি ও হাই অফিসিয়ালদের জন্য কয়েকটি চেয়ার রাখা আছে। সেই চেয়ারগুলোতে শিশুসহ কয়েকজন শুয়ে থাকতে দেখা গেছে।
রাত আড়াইটায় বিমানবন্দরের তৃতীয় তলায় গাড়ি পার্কিংয়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকই ঘোরাফেরা করছেন। এক বৃদ্ধা বসে খাবার খাচ্ছেন। সাথে একটি শিশুও রয়েছে। এক পর্যায়ে কথা হয় ওই বৃদ্ধার সাথে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, তার মেয়ে জর্ডান যাবে। সকালে ফ্লাইট হওয়াতে মধ্যরাতে বিমানবন্দর উপস্থিত হয়েছেন তারা। কিন্তু বিমানবন্দর এসে গাড়ি পার্কিংসহ নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
রাত ২টা ৫০ মিনিটের সময় আরটি-পিসিআর ল্যাবের রিপোর্ট ডেলিভারি রুমে গিয়ে দেখা গেছে, রুমের ভেতরে একজন যুবক বসে আছেন। এক পর্যায়ে ওই যুবকের সাথে কথা হয়। এ সময় খলিল উল্যা নামের ওই যুবক ইনকিলাবকে বলেন, রাত ১১টা ৩০ মিনিটের সময় আমার কুয়েত এয়ারওয়েজের কেইউ ২৮৪ ফ্লাইটে দুবাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে আসি। নির্ধারিত সময়ে ইমিগ্রেশনে জন্য লাইনে দাঁড়াই। কিন্তু ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় ফ্লাইট মিস করি।
ফ্লাইট মিস করেও কেন বিমানবন্দরে বসে আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন অনেক রাত। কোথায় যাব? তবে সকালে আবার ইমিগ্রেশনে গিয়ে দেখব দুবাই যাওয়া যায় কি না। ফ্লাইট মিস করে বাকরুদ্ধ অবস্থায় বোকার মতোই কথা বলছিলেন তিনি।
গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় খলিল উল্যা নামের ওই যাত্রীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগযোগ করা হয়। এ সময় তিনি বলেন, আমি নতুন করে আবার টিকেট কেটেছি। আজ ২২ ডিসেম্বর দুবাইয়ের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করব। শুধু খলিল উল্যাই নয়, তার মতো অনেকেই প্রতিনিয়ত ফ্লাইট মিস করছেন বলে জানা গেছে। রাত ৪টায় বিমানবন্দর গাড়ি পার্কিংয়ের স্ন্যাক্সস কর্ণারে গিয়ে দেখা গেছে, যাত্রীরা সেখানে ভিড় করছে। আবার কেউ কেউ বসে অলস সময় পার করছে।
গত বুধাবার দিবাগত রাত ১১টায় গিয়ে দেখা গেছে, বিদেশী ফেরত যাত্রীদের জন্য শত শত মানুষ বিমানবন্দরে দুই নম্বর টার্মিনালে অপেক্ষা করছেন। এছাড়াও যাত্রীরা এসে বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ভেতরে ইমিগ্রেশন ও বাইরে গাড়ি চালকদের দালাল চক্রের কাছে হয়রানি হচ্ছেন অনেকেই। বগুড়া এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আমার ভাইকে নিয়ে বিমানবন্দরে এসেছি। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস চালক চক্রের সদস্যদের কাছে হয়রানির শিকার হয়েছি। বিষয়টি একাধিকাবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করলেও তারা কোনো সহযোগিতা করেনি।
হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনা ও যাত্রী হয়রানির হাজারো অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ রয়েছে সুখঃনিদ্রায়। উল্টো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এলাকায় ‘স্থাপনা নির্মাণ’ কাজের কারণে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা রানওয়ে বন্ধ রাখছে কর্তৃপক্ষ। এভাবে টানা ৬ মাস ফ্লাইট উঠানামা বন্ধ থাকবে। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের কারণে যাত্রী সেবা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন যাত্রীরা। পরে গত ৯ ডিসেম্বর ‘যাত্রীসেবা বিঘ্নের শঙ্কা’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরদিন বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কোনো ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারেনি। ওই দিন রাতে গণধিকৃত ডা. মুরাদ হাসানের ফ্লাইটও প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যায়। পরে অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে গত ১১ নভেম্বর ‘অব্যবস্থাপনায় চরম ভোগান্তি’ নামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় দৈনিক ইনকিলাবে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শনে যান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। এ সময় শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক তৌহিদ-উল আহসানসহ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকারও করে দুঃপ্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী। এমনকি এসব ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে ফ্লাইট ছাড়ার ৮ ঘণ্টা আগে যাত্রীদের বিমানবন্দরে আনার জন্য দায়সাড়া বক্তব্য দেন তিনি।
সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১৩ ডিসেম্বর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণলায়। তাতে বলা হয়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনায় লোকবল ও সরঞ্জাম (ইকুইপমেন্ট) সঙ্কট চলছে। এতে কার্যক্রম তদারকি ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবও দেখা গেছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে। এখন প্রতিদিন ২৭টি এয়ারলাইনসের ১১০ থেকে ১২৮টি ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। এই বিপুলসংখ্যক যাত্রী এবং এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার জন্য বিমানের পর্যাপ্তসংখ্যক জনবল ও সরঞ্জাম নেই বলেও সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের আওতায় প্রতিটি এয়ারলাইনের যাত্রীদের চেক-ইন কাউন্টার সামলানো, বোর্ডিং, উড়োজাহাজে মালামাল ওঠানো-নামানো, যাত্রীসেবা, প্রকৌশল সেবা এবং জিএসই (গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট) সেবা দেওয়ার দায়িত্ব বিমানের। নির্দিষ্ট হারে ফি দেওয়া হয়। আর এটা তদারকির দায়িত্বে থাকেন বিমানের একজন মহাব্যবস্থাপক (এয়ারপোর্ট সার্ভিস)। কিন্তু বিমান পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম ও তদারকির অভাবে এসব কার্যক্রম সম্প্রতি ব্যাপকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। ফলে যাত্রী দুর্ভোগ এবং ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনা বাড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিমানবন্দরে একসঙ্গে তিনটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এসে নামলে যাত্রীসেবা এলোমেলো হয়ে পড়ে। একটি মাত্র স্ক্যানিং যন্ত্র থাকার কারণে বিদেশফেরত যাত্রীদের লাগেজ স্ক্যানিংয়ে সময় লাগে। সেখানে যাত্রীদের দীর্ঘ সারিতে পড়তে হয়। উড়োজাহাজ থেকে বেল্টে মালামাল আসতে বেশি সময় লেগে যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও কলকাতা থেকে আসা যাত্রীদের তল্লাশির মুখে পড়তে হয় বেশি।
রাজিব মিয়া নামের এক যাত্রী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সম্প্রতি তিনি মালয়েশিয়া থেকে দুটি লাগেজ নিয়ে দেশে আসেন। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে একটি লাগেজ নিয়ে বাসায় ফিরলেও আরেকটি লাগেজের কোনো সন্ধান পাননি। সংশ্লিষ্টদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও ওই লাগেজটি পাননি তিনি। তবে লাগেজটি না পাওয়াতে ইতোমধ্যে লিখিত একটি অভিযোগও দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দরে জনবল বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে কোনো সমস্যা নেই। তারপরও কোনো ভোগান্তি বা হয়রানির শিকার হলে লিখিত অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন