শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলামে দা’য়ীদের দায় ও দায়িত্ব

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা | প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলাম কোন নতুন ধর্ম নয়, বরং সৃষ্টির শুরু থেকেই ইসলামের উৎপত্তি। আদম (আ.) ছিলেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব এবং ইসলামের প্রথম নবি। আর শেষ নবি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের মধ্য দিয়ে নবুয়তের অবসান ঘটে। নবীর অবসানে ওলামায়ে কেরামকে নবীর উত্তরসূরী করা হয়েছে। তাদের উপর অর্পিত হয়েছে মহান দায়িত্ব। যুগে যুগে আলিমগণ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্রত আছেন।তবে আলিমদের বড় একটা অংশ নিজেদের আলিম বলে দাবি করলেও ইলমের ঘাটতিসহ নানাবিধ ঘাটতি তাদের রয়েছে।যুগে যুগে তারাই ইসলামের খেদমতের নামে দ্বীনের ক্ষতি করে আসছে। ইসলাম কি চায়, তা না বুঝেই নিজের মত করে ধর্মের ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন।
বর্তমান সময়ে আলেমদের সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো গণহারে নিজেদের দা’য়ী ইলাল্লাহ বলে দাবি করা। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রতিটি মুসলিমই দা’য়ী ইলাল্লাহ। ফলে বহুলাংশে ইসলাম বিকৃত করার দায়ে দায়ি হচ্ছেন। যে দায় তারা অস্বীকার করতে পারেন না। তারা জোর দিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা আমার একটি বাণী হলেও প্রচার কর। আলোচ্য হাদীসটি সহিহ। হাদিসের আমল অত্যাবশ্যক। কিন্তু এই হাদিসের ভিত্তি মূল কুরআনের সূরা সফের আয়াতটি তারা বলেন না। আল কুরআনের সূরা সফের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না। ’
সুতরাং প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের এমন কথা বলা উচিত, যা তারা নিজেরা পালন করে । কিন্তু অনেক আলিমই নিজে আমল না করে মানুষকে আমলের দাওয়াত দিচ্ছে। আসলে উক্ত দাওয়াত ইসলাম ও মানুষের জন্য অকল্যাণকরতো বটেই পাশাপাশি দাওয়াত দানকারীর জন্য ক্ষতিকর বটে। কেননা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আুলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে নেক আমল না করে অন্যকে তা করতে উপদেশ দাতার জন্য শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-হযরত উসামা বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,’ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে এনে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। এর ফলে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে আসবে। সে এটা নিয়ে বার বার চক্কর দিতে থাকবে, যেভাবে গাধা চক্রের মধ্যে বারবার ঘুরতে থাকে। দোজখীরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে জিজ্ঞাসা করবে, হে (অমুক) লোক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি কি লোকদেরকে সৎ কাজের আদেশ দিতে না এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বলতে না?জবাবে সে বলবে, ‘হ্যাঁ’ আমি সৎ কাজের আদেশ দিতাম কিন্তু আমি নিজে তা পালন করতাম না। আমি অন্যদেরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতাম কিন্তু আমি নিজে তা মানতাম না। ’ (বুখারি ও মুসলিম)
বর্তমানে চলছে দাওয়াতী ব্যবসা। মাহফিল, ওয়াজ, জলসা, সম্মেলনসহ ইত্যাদি নামে সে ব্যবসা প্রসার ঘটছে। কণ্ঠ ভালোতো, ওয়াজের মাঠে দাওয়াতের ব্যবসা ভালো। রম্য, গুজব, গান, ডং ও খোশ গল্পে জমে উঠে ওয়াজের মাঠ। ভণ্ড দালাল হুজুরদের কারণে মাহফিলের মত পুণ্য কাজটাও আজ আমাদেরকে বিষিয়ে তুলছে। হক্কানী ওলামায়ে কেরামও আজ অনেকাংশে কথিত মাহফিল জলসার বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য পেশ করছে। ওয়াজের মাঠগুলো আবার রাজনৈতিক মঞ্চেও পরিণত হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে মহিলাদেরকেও অতিথি হিসেবে ওয়াজের মঞ্চে দেখা যায়। আবার কিছু হুজুর ওয়াজের মাঠে ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। তারা সিয়াসাতুল ইসলামিয়া নিয়ে দু’কলম পড়াশোনা না করলেও হাবভাবে ধর্মীয় রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞানী ভাব তুলে ধরতে ভুল করেননা। না জেনে না বুঝেই কি সব বক্তব্য দেয়,যাহা আসলেই বোধগম্য নয়। অনেক সময় সে সকল বক্তব্য হাস্যকরে পরিণত হয়। আফসোস, ইসলাম কি বলে আর আলিম কি করছে?
আল্লাহ পথের দা’য়ীর প্রথম সম্বল হবে আল্লাহর কিতাব আল কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীসের ইলমের দ্বারা পাথেয় সংগ্রহ করা। ইলম ব্যতীত দাওয়াত অজ্ঞতাপূর্ণ দাওয়াত। আর অজ্ঞভাবে দাওয়াতের সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি। কেননা একজন দা’য়ী নিজে একজন পথপ্রদর্শক ও উপদেশ দাতা। আর সে দা’য়ী যদি অজ্ঞ হয় তবে সে নিজে পথ ভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথ ভ্রষ্ট করবে। তার অজ্ঞতা দু’টি অজ্ঞতাকে শামিল করে। আর যে অজ্ঞতা দুটি অজ্ঞতাকে শামিল করে তা সাধারণ অজ্ঞতার চেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কেননা সাধারণ অজ্ঞতা ব্যক্তিকে কথা বলা থেকে বিরত রাখে, তবে শিক্ষার মাধ্যমে এ অজ্ঞতা দূরীভূত হয়। কিন্তু জাহলে মুরাক্কাব তথা না জেনে জানার ভান করাই হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা এ ধরনের অজ্ঞরা কখনো চুপ থাকে না, বরং না জেনেও কথা বলতে থাকে। তখন তারা আলোকিত করার চেয়ে ধ্বংসই বেশি করে।
দা’য়ীদের বিশেষ গুণ থাকা আবশ্যক। যেমন, প্রথমত: যে দিকে দাওয়াত দিবে সে ব্যাপারে শরয়ী জ্ঞান থাকতে হবে। কেননা সে হয়ত কোন কাজ ফরয ভেবে সেদিকে আহ্বান করবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তা ফরয নয়। ফলে সে আল্লাহর বান্দাহর উপর অনাবশ্যকীয় জিনিসকে অত্যাবশ্যকীয় করে দিবে। আবার কখনও সে হারাম ভেবে তা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান করবে, অথচ তা আল্লাহর দ্বীনে হারাম নয়, ফলে সে আল্লাহর হালালকৃত জিনিসকে হারাম করল।
দ্বিতীয়ত: দাওয়াতের অবস্থা সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। দা’য়ী যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানবে। তাদের ইলমী অবস্থা কি সে সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত হবে। তাদের তর্ক বিতর্ক করার দক্ষতা কি তাও জানবে যাতে প্রস্তুতি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক করতে হবে। কেননা যখন এ ধরনের বিতর্কে লিপ্ত হবে তখন সত্যের বিজয়ের জন্য শক্তিশালী হতে হবে। সহীহ বুখারিতে বর্ণিত আছে ‘উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা মামলা মুকাদ্দমা নিয়ে আমার কাছে আস এবং তোমাদের একজন অপরজন অপেক্ষা অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আমি কথা শুনে তার অনুকুলে রায় প্রদান করি’। এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, বাদী মিথ্যাবাদী হলেও কখনও কখনও অন্যের চেয়ে অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, ফলে বিচারক তার কথা শুনে তার অনুকূলে ফয়সালা দিয়ে থাকে। তাই যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানা আবশ্যক।
তৃতীয়ত: দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। (সূরা: আন-নাহাল: ১২৫)।
কিছু মানুষ খারাপ কাজ দেখেই তা বন্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু ভবিষ্যতে তার ও তার মত অন্যান্য হকের প্রতি দা’য়ীদের উপর কি ফলাফল বর্তাবে তা নিয়ে চিন্তা করে না। অনেকাংশে মন্দ কাজ দেখা মাত্রই তা বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগে এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনা। এজন্যই দা’য়ীদের উচিত কোন আন্দোলনে নামার আগে তার ফলাফল কি হবে তা খেয়াল করা ও সে বিষয়ে অনুমান করা। সে সময় হয়ত তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে যা ইচ্ছা তা করল, কিন্তু পরবর্তীতে দা’য়ী ও অন্যান্যদের প্রভাবের কারণে চিরতরে কাজটি নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। এটা হয়ত শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। এজন্যই দায়ীদেরকে হিকমত ও ধীরস্থীরতার সাথে কাজ করতে হবে। যদিও এতে কিছুটা বিলম্ব হয়, তথাপি শেষ পরিণাম হবে আল্লাহর ইচ্ছায় সুদূরপ্রসারী।
কুরআন ও সুন্নাহের সহীহ ইলমের সাহায্যে দায়ীর পাথেয় সংগ্রহ করা জরূরী। কেননা আপনার পথ জানা না থাকলে কিভাবে আল্লাহর পথে ডাকবেন? আপনি শরীয়ত সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাহলে কিভাবে আপনি দা’য়ী ইলাল্লাহ হবেন?তাই মানুষের যদি ইলম না থাকে তবে সর্বপ্রথম তাকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, তারপরে আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা উচিত। নচেৎ দ্বীনের দা’য়ী মূর্খতার কারণে দায়িতে রূপান্তরিত হবেন।
মহান প্রভূ দ্বীনের দায়ীদেরকে সঠিক জ্ঞান আহরণ ও তা নিজ জীবনে ধারণ পূর্বক দাওয়াত দানের তাওফিক দান করুন। আমীন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন