হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর আগমনপূর্ব যুগটি ছিল দলাদলি, হানাহানি ও রক্তারক্তির যুগ। মানুষে মানুষে ছিল রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও আভিজাত্যের দুর্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর। সমাজ ছিল তখন পশুত্ব ও পৌত্তলিকতার নিকষকালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত। মানুষ ছিল তখন শান্তিহারা, অধিকারহারা, নির্মমভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত। নারী জাতির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। এক কথায় তৎকালীন মানবসমাজে মুক্তি, শান্তি ও প্রগতির আশা হয়ে উঠেছিল সুদূরপরাহত। মানবেতিহাসের এই ঘোর দুর্দিনেই বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. মানবতার মুক্তির সনদ নিয়ে সুন্দর এই বসুন্ধরায় আগমন করেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’ মূলত তাঁর আগমনই ছিল মানবকুলের জন্য অপূর্ব নিয়ামত, রহমত ও চিরন্তন শান্তির মহান সওগাত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরম বন্ধুরূপে অন্যায় ও অসাম্যকে তিরোহিত করে সাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর মহান ব্রত।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি; তিনি কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের জন্যও প্রেরিত হননি; তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। রব্বুল আলামিন বলেন: ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সুরা-৩৪ আস সাবা, আয়াত : ২৮)।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি ইমামুল আম্বিয়া, সাইয়িদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব, প্রিয় বন্ধু। আল্লাহর ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পেতে হলে প্রিয় নবী (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে নবী (সা.)! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে তোমরা আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)। সহজে বলা যায়, রাসুল (সা.) এসেছিলেন আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করতে। এ বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেন: ‘আমি আল্লাহর অতিপ্রিয় বন্ধু; গৌরব করি না।’ (বুখারি শরিফ)।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। মহানবী (সা.) বললেন, তার পেশাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি পেশাবের ওপর ঢেলে দেয়া হল’ (সহিহ বোখারি, কিতাবুল আদব)। মহানবীর (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে তিনি ইহুদীর লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদীর লাশ বিশ্বনবীর (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবী (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়।
পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো ইহুদীর লাশ। এতে আল্লাহর রাসুল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবী এক ইহুদীর লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদেরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবীর উম্মতের পক্ষে কিভাবে সম্ভব শুধু ধমী মতপার্থক্যের কারণে কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার করা। হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখো যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব’ (আবু দাউদ)।
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে অনুকরণ–অনুসরণ করে চলছে তাঁর জীবনাচার ও অনুপম মহান আদর্শ। সব মানুষের হৃদয়ে তিনি জ্যোতির্ময় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। ধর্মকে মানব জাতির কল্যাণে প্রয়োগ করতে শিখিয়েছেন। নারীর অধিকার, শ্রমের মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় সংবিধান, যুদ্ধ কৌশল, সব কিছুই শিখিয়েছেন মহানবী (সা.)। মহাবীর আদর্শ ও ইসলামের সুশীতল ছায়া মানব জাতির আশ্রয়স্থল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ মেনে চললে ইহকাল ও পরকালে রয়েছে শান্তি এবং মুক্তি।
মুহাম্মদ (সা.)আল্লাহর রাসূল। সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি আল্লাহর দয়ার বাস্তব নিদর্শন তিনি। প্রেম এবং করুণার সম্মিলন তাঁর চরিত্রে অপূর্বভাবে বিমূর্ত হয়েছে। তাঁর প্রচারিত নীতি এবং আদর্শ কালো-সাদা, আরব-অনারব, ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ সবাইকে এককাতারে শামিল করেছে। কালোত্তীর্ণ এ মহামানুষ এ নশ্বর ধরাধামে মহান আল্লাহর গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ করে গেছেন। জগতের সব জড়চিন্তা, ভুয়া মতবাদ এবং মানবতাবৈরী সব শক্তিকে পর্যুদস্ত করে মানবতার এই মহান বন্ধু চির অমর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। তিনিই আমাদের একমাত্র আদর্শ। তাঁর চেয়ে বড় বন্ধু আর কোনো দিন কেউ হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে বিশ্ব মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন