ছোট একটি বাসা। একটি স্থায়ী ঠিকানা। একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই। একটি নিরাপদ আশ্রয়। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি ভিত্তি। সবমিলিয়ে একটি স্বপ্ন। ছোট ছোট শব্দে কথাগুলো লেখা গেলেও বাস্তবতা খুবই নিষ্ঠুর। আশার অপর নাম জীবন। মানুষ অনেক কিছু আশা করতে পারে। তবে যাপিত জীবনে যা অত্যন্ত প্রয়োজন তা হলো বাসা। হোক তা ছোট কিংবা বড়। জীবনটা নিরাপদে কাটিয়ে দেওয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে নিজের একটি বাসা। বাবুই পাখি নিজেও তালগাছের মাথায় বিভিন্ন স্থান থেকে খড়কুটো সংগ্রহ করে সুন্দর ছোট একটি বাসা তৈরি করে। তার চোখেও স্বপ্ন ভালোভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন।
নাগরিক জীবনে প্রতিটি নাগরিক তার সাধ্যমতো সুন্দর একটি বাসা খোঁজে। হোক তা ফ্ল্যাট কিংবা প্লট। প্লট হলে তো নিজের মতো সাজিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। ফ্ল্যাট কিংবা প্লট হাতের নাগালে এনে দিতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের স্বনামধন্য আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা। এই আবাসন খাত একদিকে যেমন মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। শুধু কি তাই, নিত্যনতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে। আবাসনের সঙ্গে গড়ে উঠেছে লিঙ্কেজ শিল্প। আবাসনসহ এসব লিঙ্কেজ শিল্প সরকারকে রাজস্ব এনে দিচ্ছে। পাশাপাশি শিল্প প্রসারের মাধ্যমে সার্বিক নির্মাণ খাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ অবদান রেখে আসছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ।
গতকাল পাঁচদিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রে রিহ্যাব মেলা-২০২১ এর চতুর্থ দিনে নিজস্ব বাসস্থানের স্বপ্নপূরণে সাধ ও সাধ্যের সমন্নয় ঘটাতে অনেক মানুষ খোঁজ করেছেন ছোট ফ্ল্যাটের। সাধ্য অনুযায়ী অনেকে বড় ফ্ল্যাট-প্লটও খোঁজ করেছেন। বেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছে মেলায় অংশ নেওয়া ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো। মেলা শেষ দিকে চলে আসায় ক্রেতা সমাগম বেশি হওয়ায় জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফ্ল্যাট এবং প্লটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ক্রেতাদের নিকট। একসঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির ফ্ল্যাট ও প্লটের খোঁজ নেন ক্রেতারা। মেলায় অনেকেই আসেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। কেউ আসেন বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে। এক ছাদের নিচে গৃহঋণসহ নির্মাণ সামগ্রীর সমাহার থাকায় সন্তোস প্রকাশ করেন ক্রেতারা। এবারের মেলায় ক্রেতারা ছোট ফ্লাটের খোঁজ করছেন বেশি।
করোনাকালে আবাসন খাত বেশ কিছুটা গতি হারিয়েছিল। সেই করোনার প্রভাব সামলে আবাসন খাতে আবার গতি ফিরে আসছে। বিশেষ করে বাজেটে বিনাপ্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা। পাশাপাশি ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কিছুটা কমানোর ফলে নতুন করে বুকিং বেড়েছে। তবে কিছু নতুন সমস্যও সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর ম‚ল্য বেড়ে যাওয়া। যে কারণে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। আর নির্মাণসামগ্রী বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়ের বোঝা ক্রেতাদের ওপর চাপছে। রডের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রড ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বিশ্ববাজারে গলনশীল স্ক্র্যাপের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতিতে দামও বেড়েছে।
প্লট এখন অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। কারণ একখন্ড প্লট নিলে নিজের মতো করে বাড়িটা তৈরি করতে পারে। প্লট আবার এমন অনেক জায়গায় খুঁজছেন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন করা যায়। ভালো প্লটের সন্ধান দিচ্ছেন আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা। অনেকে এমন প্লটের সন্ধানে রয়েছেন, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হচ্ছে। এসব প্লটের সন্ধান দিতে এখন আর পিছিয়ে নেই আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, এবারের মেলায় ২২০টি স্টল বসানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ডায়মন্ড প্যাভিলিয়ন, ছয়টি গোল্ড স্পন্সর, ২২টি কো-স্পন্সর, ১৫টি ভবন তৈরির পণ্য ও ১৩টি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। এসব স্টলে রয়েছে সরাসরি ফ্ল্যাট বা প্লট বুকিং দেওয়ার সুবিধা। বুকিং দিলেই পাওয়া যাচ্ছে ম‚ল্য ছাড়। এ ছাড়া এককালীন ম‚ল্য পরিশোধে রয়েছে বড় অঙ্কের ছাড়ও। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য সহজ কিস্তিতে ফ্ল্যাট ও প্লট কেনার সুবিধা রয়েছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের। আছে সাধ ও সাধ্য অনুসারে ঢাকার যেকোনো এলাকায় ফ্ল্যাট ও প্লট বুকিং দেওয়ার সুযোগ। মিলছে ঋণ সুবিধাও। এক ছাতার নিচে সব দেখে নিজের মনমতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সবাই।
জেএমআই বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্টলের সামনে কথা হয় সাভারের বাসিন্দা শাহনেওয়াজের সঙ্গে। সদ্য পড়াশোনা শেষ করা শাহনেওয়াজ মেলার প্রথম দিন উপস্থিত হয়েছেন ফ্ল্যাটের দাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিতে। তিনি বলেন, আমি এখনো কোনো চাকরিতে ঢুকিনি। মা-বাবাসহ সাভারে পরিবারের সঙ্গে থাকি। আব্বু কিছু টাকা জমিয়েছেন। এই বছরই একটা ফ্ল্যাট নিব আমরা।
ফ্ল্যাট-প্লট কেনার বিষয়ে যেমন দর্শনার্থীরা মেলায় আসছেন, আবার নিজেদের কেনা জায়গায় অংশীদারির ভিত্তিতে আবাসন গড়ে তোলার বিষয়ে তথ্যের জন্যও অনেককে আসতে দেখা গেছে। কাফরুলের এক বাসিন্দা বলেন, একটা ফ্ল্যাট কেনার উদ্দেশ্যে আসলাম। এই মেলাটা খুব জরুরি। কারণ অনেক প্রতারকের ভিড়ে আমরা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজি। এই মেলায় যারা আসেন তাদের নিশ্চয় যাচাই-বাছাই করেই স্টল দেওয়া হয়। তা ছাড়া একই জায়গায় অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি থাকায় আমরা পার্থক্য করতে পারি।
রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট (অর্থ) এবং মেলা কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, এই মেলার জন্য নগরবাসী সারা বছর অপেক্ষায় থাকে। গত বছর আমরা করোনার জন্য আয়োজন করতে পারিনি। আশা করছি এবার ভালো দর্শনার্থী হবে। এ বছরের মতো ছাড়ে এবং কম দামে আর ফ্ল্যাট ও প্লট পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
স্বল্প দাম নির্ধারণের বিষয়ে কথা হয় ইছহাক ডেভেলপার্সের পরিচালক প্রকৌশলী ফরহাত আফজা লুবনার সঙ্গে। তিনি বলেন, আবাসন মেলায় মধ্যবিত্তের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করেছি। কারণ গ্রাহকরা সাধ্যের মধ্যে মানসম্মত ফ্ল্যাট নিলে পরবর্তীতে তারা ইছহাক ডেভেলাপার্সকে খুঁজবে। আমরা অতিরিক্ত মুনাফা করতে চাই না। এছাড়া আমরা করোনার সময়ে ফ্ল্যাট তৈরি করেছি। এই সময় নিমার্ণ খরচ তুলনামূলক কম হয়েছে। তাই আমরা স্বল্প দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করছি। গ্রাহককে আমরা ভালো মানের ফ্ল্যাট দিতে চাই। আমাদের মূল লক্ষ্যই গ্রাহকের আস্থা তৈরি করা। ইতিমধ্যে আমরা রাজধানীর উত্তরায় একটি প্রকল্প শেষ করেছি। এছাড়া রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র এ্যালিফ্যান্ট রোডে আমাদের দুটি প্রজেক্টের কাজ খুব শিগগরিই শুরু হবে। নির্মাণ সামগ্রী থেকে শুরু করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন টেকসই ফ্ল্যাট গ্রাহককে দিতে চান বলেও জানান এই প্রকৌশলী।
মেলায় স্টল নিয়ে আসা আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের বিপনন ও বিক্রয় শাখার প্রধান মোহাম্মদ তানভিরুল ইসলাম জানান, এবার ভালো মানের ক্রেতাদের সাড়া পাচ্ছেন, তবে বেশিরভাগেরই মধ্যম মানের ফ্ল্যাটে আগ্রহ। তিনি জানান, এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি বেশ ভালো। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ফ্ল্যাট ক্রয়ে এবার বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে, তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ও রয়েছে। কোন এলাকার ফ্ল্যাটে সাড়া বেশি জানতে চাইলে তিনি জানান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শান্তিনগর, পল্টন এলাকার ফ্লাটে চাহিদা বেশ ভালো।
এদিকে আবাসনের জন্য সব চাইতে নিরাপদ ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রতি ক্রেতা-দর্শনার্থীদের বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, মেলায় অনেকেই সরাসরি বুকিং দিয়ে কিছু আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী আবাসন নিশ্চিত করতে সব কটি প্রতিষ্ঠান মেলা উপলক্ষে বাড়তি ছাড় দিয়েছে। কিস্তিতে ফ্ল্যাট ও প্লট বুকিং দেওয়ার সুবিধাও রাখা হয়েছে। মেলা থেকে সরাসরি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তাই দুই বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা ক্রেতারা এবার ভালো সাড়া দেবেন।
সরকার যদি সহায়তার নীতি নিয়ে এগিয়ে আসে তা হলে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবাসনের খাতে অর্থায়নের চাহিদা ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই চাহিদা আরও ৫ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত ১১টি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন।
সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করা গেলে কবির লেখা কবিতা নিয়ে শুধু ভাবতেই ভালো লাগবে না, পড়তেও ভালো লাগবে। তখন হয়তো নিজেই মনে মনে কবিতার লাইন বানিয়ে প্রিয়জনকে শোনাবে, ‘তোমায় নিয়ে ঘর বানাবো/বিজন কোন দূরে/ভালোবাসা থাকবে শুধু/ছোট্ট এ ঘর জুড়ে’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন