‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন’ হয়েছে ২০১২ সালে। একদশকেই আইনটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। সাধারণের মাঝে প্রতিপালনের চেয়ে লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার মাত্রা এতোটাই বেশি যে, লিখন আর পোস্টার নিয়ন্ত্রণে আইনের কোনো অস্তিত্ব রয়েছে বলেই মনে হয় না। আর আইন লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই। এক দশকে আইনটির অহর্নিশ লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তির ঘটনা নেই একটিও। যদিও আইনে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মোবাইল কোর্টকে।
মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় নিয়োজিত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কার ওপর আইন ফলাবো? দেয়ালে সাঁটা পোস্টারে যাদের ছবি থাকে বাস্তবে তাদের ওপর কি আইন প্রয়োগ সম্ভব?
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা ভবন, দেয়াল, স্থাপনা, ফ্লাইওভারের পিলার বহু রঙা পোস্টার, দেয়াল লিখন আর বাহারি ব্যানারে ছেয়ে গেছে। যেন পোস্টার দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। পোস্টারের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল। পোস্টার লাগানোর প্রতিযোগিতায় এক পোস্টারের ওপর লাগানো হচ্ছে আরেক পোস্টার। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আধিপত্য বিস্তারের মহড়া লক্ষ্য করা যায় পোস্টারে। একেকটি পোস্টার যেন নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার স্বাভাবিক দাবির প্রতি কঠিন কটাক্ষ।
নাগরিক সৌন্দর্য রক্ষায় ২০১২ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’। জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে আইনটি প্রণয়ন করলেও আইনটি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত জনপ্রতিনিধিরাই। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ প্রশ্নে অসহায় বোধ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী।
আইনজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক দল ও আইনপ্রণেতারা যখন আইন লঙ্ঘন করেন তখন সাধারণ মানুষের কাছে আইন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর তখনই আইন প্রতিপালনের পরিবর্তে লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও আইনটি প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সিটি করর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিটিই আইনটি বেশি লঙ্ঘন করছেন। নিজে লঙ্ঘন করে অন্যকে সেটি প্রতিপালনে বাধ্য করা যায় না। দেয়া-ভবন-স্থাপনাকে পোস্টার-ব্যানার-লিখনমুক্ত রাখার দায়িত্ব যার ওপর তাকেই আইন লঙ্ঘন করতে দেখলে অন্যে তা প্রতিপালন করবে কেন?
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১২’র ৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে উল্লেখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতিত অন্য কোন স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে।’
আইনের ‘৩’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতিত অন্য কোনো স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না।’ আইনের ‘৬’ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।
৩ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।
আইনের ‘৭’ ধারায় বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ধারা ৬ এর উপধারা (২) এর অধীন সংঘটিত অপরাধ মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ (২০০৯ সনের ৫৯নং আইন) এ উল্লেখিত মোবাইল কোর্ট কর্তৃক বিচার্য হইবে এবং ধারা ৬ এর উপধারা ৩ এর অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর চ্যাপ্টার ২৩ অনুসারে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে।’
আইনের ‘৮’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইলে উক্ত অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে কোম্পানির এমন প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; যদি না তিনি প্রমাণ করিতে পারেন যে, উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে অথবা উক্ত অপরাধ রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’
আইনের একই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোম্পানি বলিতে যে কোনো প্রতিষ্ঠান, অংশীদারী কারবার, সমিতি, সংঘ, সংগঠন ও সংস্থাও অন্তকর্ভুক্ত হইবে এবং পরিচালক বলিতে অংশীদার বা পরিচালনা বোর্ডের সদস্যকেও বুঝাইবে।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পোস্টার,ব্যানার আর দেয়াল লিখনে ছেয়ে গেছে। ২০১২ সালে ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’ প্রণয়ন করে। অথচ আইনটি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এগিয়ে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন-বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও পোস্টার বিরোধী আইনের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন। দেয়াল লিখন বিরোধী আইন লঙ্ঘনে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এক।
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, দলীয় এমপি, মহানগর ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানার-পোস্টারে দেয়াল ছেয়ে ফেলছে। জাতীয় এবং স্থানীয় অনেক সমিতি-সংগঠনও লাগাচ্ছেন পোস্টার। নির্বাচনকালে মৌসুমি পোস্টার ছাড়াই নানা ছুতোয় নেতা-কর্মীরা পোস্টার লাগাচ্ছেন।
দলের বিভিন্ন উপলক্ষ, নতুন কমিটি ঘোষণা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জন্মাবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, দুর্গাপুজা, জন্মাষ্টমী, বড়দিন-উপলক্ষের যেন শেষ নেই। অমুকের সৌজন্যে তমুক। বাহারি পোস্টারে শুধু ছবি আর ছবি। অনেক সময় কোনো ধরণের বক্তব্য ছাড়াই পোস্টার ছাপানো হচ্ছে ছবি সম্বলিত। কেন কি কারণে কে পোস্টার লাগিয়েছেন সেটিও বোঝার জো নেই পোস্টার থেকে। আত্মপ্রচার, আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতা জাহির করার উদ্দেশ্যে দেয়ালে লাগানো হয় পোস্টার।
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১২’ অহরহ লঙ্ঘনের বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরসেদ বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আইন রয়েছে। বহু আইন রয়েছে প্রয়োগ হয় না। আলঙ্করিক আইন। দেয়াল লিখন (নিয়ন্ত্রণ) আইন তেমনই একটি। তিনি বলেন, আইন কার্যকরের বিষয়টি নির্ভর করতে প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতার ওপর। আইনের চোখে সবাই সমান বলা হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনটি লঙ্ঘন করছেন। আইন প্রয়োগকারীরা তাদের শাস্তির আওতায় আনতে ভয় পাচ্ছেন। আইন প্রণয়নের পর সেটি কার্যকরে আন্তরিক না হলে এ ধরণের আইন নাগরিকের জন্য কোনো সুফলই বয়ে আনে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেক আইনই রয়েছে যেগুলো রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা ও আইনপ্রণেতাদের মাধ্যমে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আইন অগ্রাহ্য করার দায়ে শাস্তি হওয়ার দৃষ্টান্ত না থাকায় আইনটি কার্যকরিতা হারায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আইনের প্রতি প্রদ্ধাশীল হতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন