উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি আর সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়িতে বছরজুড়েই জনদুর্ভোগ নাকাল হয়েছে চট্টগ্রাম নগরবাসী। আর খাল-নালায় পড়ে পাঁচটি মৃত্যুর ঘটনা ছিলো আলোচনায়। হাঁটতে গিয়ে পা ফসকে খালে পড়ে নিমিষেই গায়েব হয়ে যাওয়ার দৃশ্য নাড়া দিয়েছে সবাইকে। খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হলেও মৃত্যুফাঁদ বন্ধে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ হয়নি। চলছে নগরীর খাল, নালা সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ। সিডিএর আরো একটি মেগা প্রকল্প নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজও চলছে সম্ভুক গতিতে। পোর্ট কানেকটিং রোড, মাঝির ঘাট সড়ক, বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কসহ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি সড়কে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজ চলছে।
বছরের পর বছর এসব কাজ চলমান থাকায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। এসব প্রকল্পের পাশাপাশি ওয়াসা, পিডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজের জন্য নগরীতে চলছে খোঁড়াখুুঁড়ি। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে জনদুর্ভোগের শেষ নেই। বন্দরনগরীতে এখন যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। রাস্তায় নেমেই দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বছরজুড়েই জনভোগান্তি ছিলো চরমে। অপরিকল্পিত এবং সমন্বয়হীন রাস্তা কাটাকাটির ফলে খাল-নালা, ফুটপাত একাকার হয়ে যায়। উন্মুক্ত এক একটি খাল-নালা রীতিমত মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। খাল-নালায় পড়ে ঘটে মৃত্যুর ঘটনা। সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর মুরাদপুরের মির্জা খালে পাওয়া যায় শিশু কামাল উদ্দিনের গলিত লাশ। তিনদিন আগে নগরীর ষোলশহর এলাকায় প্লাস্টিকের খেলনা কুড়াতে গিয়ে চশমা খালে তলিয়ে যায় সে। তার সাথে থাকা এক বন্ধু সাঁতরে উঠতে পারলেও স্রোতের টানে আবর্জনার ভেতর তলিয়ে যায় কামাল।
খবর পেয়ে একদিন পর তার সন্ধানে তল্লাশি অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। পরে কয়েক কিলোমিটার দূরে মির্জা খালে শিশুটির লাশ ভেসে উঠে। ছবি হাতে মা হারা সন্তানের খোঁজে খালের পাড়ে পিতা আলী কায়সারের আহাজারির দৃশ্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গৃহহীন আলী কায়সার ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ষোলশহর রেল স্টেশনের পাশের বস্তিতে।
একই খালে পড়ে মুহূর্তে নেই হয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমদ। তার খালে পড়ে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। গত ২৫ আগস্ট টানা বর্ষণের সময় ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা ফসকে তিনি চশমা খালে পড়ে যান। তার বাসা নগরীর চকবাজারে। সেখান থেকে তিনি ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার যেতে মুরাদপুর যান। টানা প্রায় ১৫ দিন তার সন্ধানে চশমা খালসহ মুরাদপুর থেকে নগরীর কালুঘাট কর্ণফুলী নদীর মুখ পর্যন্ত সবকটি নালা ও খালে অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। তবে এখনও তার সন্ধান মিলেনি। পিতার লাশও খুঁজে পাননি ছালেহ আহমদের সন্তানেরা। তার আগে গত ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাইলেন হয়ে যাওয়ার পথে চশমা খালে পড়ে যায় একটি যাত্রীবাহী অটোরিকশা। উন্মুক্ত খালে স্রোতের টানে তলিয়ে মারা যান চালক মো. সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে চশমা কিনে নানা ও মামার সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এক টন আবর্জনা পরিষ্কারের পর উদ্ধার হয় সাদিয়ার লাশ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়িতে তখন ওই এলাকা নালা ও ফুটপাত একাকার হয়ে যাওয়ায় ঘটে এমন দুর্ঘটনা। খাল, নালায় আহত এবং পঙ্গু হন আরো অনেকে।
একের পর এক এমন দুর্ঘটনায় তোলপাড় হয়। এসব ঘটনার জন্য সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশন একে অপরকে দায়ী করে। সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী অভিযোগ করেন সিডিএ তাদের মেগা প্রকল্পের জন্য খাল-নালা সংস্কার করতে গিয়ে ¯ø্যাব তুলে নিয়েছে। অপরিকল্পিত খোঁড়াখুুঁড়ির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ পাল্টা অভিযোগ করেন খাল, নালা দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থানের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
কমিটিকে খাল, নালায় পড়ে মৃত্যুর দায় নির্ধারণ করতে বলা হয়। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এমন মৃত্যুর জন্য ওই দুটি সংস্থাকেই দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে এতে কিছুর পরও নগরীর বিশাল এলাকাজুড়ে ৫৭টি খাল, ৪০০ নালায় প্রায় দেড় হাজার উন্মুক্ত স্থান যা মৃত্যুফাঁদ হিসাবে পরিচিত সেগুলোকে নিরাপদ করতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন