দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ফুলেফেঁপে উঠেছে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে। এসব রেমিটেন্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করেন। করোনা পরবর্তী সময়ে টিকিটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতেকরে প্রবাসী শ্রমিকরা পড়ে গেছেন মহাবিপদে। দেশে আটকেপড়া প্রায় ৫০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কর্মস্থলে যেতে পরছেন না। যে সব দেশ থেকে রেমিটেন্স কম আসে; সেই ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকাগামী এয়ারলাইন্স ভাড়া বাড়ানো হয়নি। অথচ দুইগুণ তিনগুণ ভাড়া বাড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া ভুক্তোভোগী প্রবাসী শ্রমিকরা বলছেন তারা টিকিটের দাম বেড়ে যাওয়া মহাবিপদে পড়ে গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের দেশের স্বার্থেই দ্রুত বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে দেশের রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিদেশগামী কর্মীদের টিকিটের মূল্য আকাশচুম্বীর ঘটনায় সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের বিমানের টিকিটের উচ্চ মূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আমি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রীকে বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠেছি। তারপরেও কাজ হচ্ছে না। আসলে বিমান ভাড়া সহীয় পর্যায়ে নির্ধারণের দায়িত্ব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওপর। জানতে চাইলে আটাব সভাপতি মনছুর আহমদ কালাম ইনকিলাবকে বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে মধ্যপ্রাচ্যগামী টিকিটের দাম তিনগুণ বাড়িয়েছে। বর্তমানে জিডিএস সিস্টেমে সউদী দুবাইগামী টিকিটের উচ্চ মূল্য শো’করছে। মধ্যপ্রাচ্যের টিকিট ৮০ হাজার, ৮৫ হাজার ও ৯০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছে প্রবাসী কর্মীরা। এতে বিদেশগামী কর্মীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে। যে বিদেশগামী কর্মীদের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে; সেই গরিব অসহায় প্রবাসী কর্মীর প্রতি সুদৃষ্টি দেয়ার কাউকে চোখে পড়ছে না। মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলোর সিন্ডিকেট করে অনৈতিকভাবে প্রতিযোগিতা মূলকভাবে তিনগুণ ভাড়া বৃদ্ধি করছে।
ভ্রাতৃ-প্রতীম মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের চমৎকার সর্ম্পক বিরাজ করছে। বৈশ্বিক করোনা কিছুটা শিথিল হবার সাথে সাথে সউদী আরব সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী আমদানি অব্যাহত রাখছে। কিন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কর্মস্থলে যোগ দিতে অভিবাসী কর্মীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। টিকিটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে মধ্যপ্রাচ্যগামী টিকিটের মূল্য তিনগুণ বাড়িছে। অতিরিক্ত টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হিমসিম খাচ্ছে বিদেশগামী কর্মীরা। চড়া দামে টিকিট কিনতে না পেরে বিদেশগামী অসহায় কর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া বহন করে যথাসময়ে কর্মস্থালে যাওয়া অভিবাসী কর্মীদের কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহির্বিশ্বে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মীর রেমিট্যান্সের দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে বলেছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা এতো দিন আমাদের দিয়েছেন। এখন তাদেরকে দেয়ার সময় আমাদের। গরিব অসহায় প্রবাসী কর্মীদের বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
জানা গেছে মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলো ৪০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকার ওয়ানওয়ের টিকিট এখন সিন্ডিকেট করে ৮০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। বিমানের টিকিটও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চড়া দামে বিক্রির অভিযোগ উঠছে। করোনা পরবর্তী সউদী, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অভিবাসী কর্মী গমনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এয়ারলাইন্সগুলো বিমান ভাড়া ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষ কোনো কোনো প্রবাসী কর্মী দেড় লাখ টাকা দিয়ে বিজনেস ক্লাসের টিকিট কিনে কর্মস্থলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতা ও আশাকচুম্বী ভাড়া পরিশোধ করতে অসহায় গরিব বিদেশগামী কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে। বিমানের টিকিটের মূল্য ঊর্ধ্বগতি রোধে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নির্বিকার। অতিরিক্ত ভাড়া বহন করা ও যথাসময়ে কর্মস্থলে যাওয়া অভিবাসীদের জন্য প্রায় অসম্ভব ও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানসহ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর এমন অতিরিক্ত ভাড়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। সময়মত ফিরতে না পেরে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন অনেকে।
বিএমইটির সূত্র জানায়, করোনার পর গত জানুয়ারি থেকে গত ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫ লাখ ৬৪ হাজার ১১৪ জন কর্মী বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন। এর মধে জুলাই মাসে বিভিন্ন দেশে ১২ হাজার ৩৮০ জন কর্মী বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গিয়েছে। গত আগস্ট মাসে বিভিন্ন দেশে গিয়েছে ১৯ হাজার ৬০৪ জন কর্মী। সেপ্টেম্বর মাসে গিয়েছে ৪২ হাজার ৮ জন কর্মী। গত অক্টোবর মাসে গিয়েছে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন কর্মী। নভেম্বর মাসে গিয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী। গত ১ ডিসেম্বর থেকে গত ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু হয়েছে ৭৮ হাজার ২১৯ জন কর্মীর। যথা সময়ে টিকিট না পাওয়ায় এবং টিকিটের অতিরিক্ত টাকা যোগাতে না পেরে এদের অনেকেই কর্মস্থলে যেতে পারছে না। অনেক প্রবাসী কর্মীর ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কর্মীর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার কর্র্মী বিদেশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিমানসহ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিদিন তিন হাজার কর্মী পরিবহন করছে। হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমান বন্দরে নির্মাণ কাজ চলায় চলতি মাস থেকে রাত ১২টা থেকে সকার ৮টা পর্যন্ত সকল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট উঠা নামা বন্ধ থাকবে। এ সুযোগে এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে টিকিটের দাম দেদারসে বাড়াচ্ছে। চড়া দামে টিকিট কিনে কর্মস্থলে যেতে প্রবাসী কর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন। করোনা মহামারির সঙ্কটকালে প্রবাসী কর্মীর পরিবারগুলোও অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ প্রবাসী কর্মী নিরুপায় হয়ে জমিজমা গবাদি পশু বিক্রি এবং ঋণ করে টিকিটের টাকা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে এয়ারলাইন্সগুলোর বিরুদ্ধে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রবাসী কর্মীরা। যেসব কর্মীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে বা নিয়োগকর্তার তাগিদ রয়েছে সেসব কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের ওয়ানওয়ে টিকিট এক লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়েও কিনতে বাধ্য হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব বিষয় দেখার কেউ নেই।
আটাবের শীর্ষ নেতা জুম্নন চৌধুরী বলেন, দু’মাস আগেও সালাম এয়ার ঢাকা-রিয়াদ রুটে ওয়ানওয়ে টিকিট ৪৩০ মার্নিক ডলারে বিক্রি করছে। গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ওয়ানওয়ে টিকিট বিক্রি করেছে ৫৫০ মার্নিক ডলারে বিক্রি করেছে। সাউদিয়া এরাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ঢাকা-রিয়াদ রুটের ওয়ানওয়ে টিকিট বিক্রি হয়েছে ৬১ হাজার ৪৬৫ টাকায়। গত ২৭ ডিসেম্বর সউদিয়া এয়ারলাইন্সের ঢাকা-রিয়াদগামী টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৪৯ টাকায়। সউদী ও দুবাইগামী প্রবাসী অসহায় গরিব কর্মীরা চড়া দামের টিকিট ক্রয়ের টাকা যোগাতে আত্মীয়-স্বজনের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
মতিঝিলস্থ বিমান অফিসে টিকিট কিনতে আগত একজন যাত্রী বলেছেন, এখন আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। যদি ১ লাখ টাকা টিকিটের দাম হয়, তাহলে অনেকেই ঋণ করে বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে। টিকিটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে চট্টগ্রাম হাব চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বলেছেন, একজন কর্মী যাত্রীর যদি দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা গুনতে হয়, সেটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। অনেক যাত্রী অতিরিক্ত বিমান ভাড়া পরিশোধ করেও কাক্সিক্ষত সিট পাচ্ছেন না। ফলে অনেকেরই যেমন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি চাকুরি হারানোর শঙ্কায় শত শত প্রবাসী কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নূরুল হক নূর বিদেশগামী কর্মীদের টিকিটের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গরিব অসহায় কর্মীদের বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার জোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুদেলাতে ধনী ব্যক্তিরা সফর করেন। তাদের ভ্রমণের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। শুধু মধ্যপ্রাচ্যগামী গরিব অসহায় কর্মীদের বিমান ভাড়া আকাশমুম্বী করা হয়েছে। তিনি অবিলম্বে প্রবাসী কর্মীদের বিমান ভাড়া কমিয়ে আনার অনুরোধ জানান।
আটাব এর চট্টগ্রাম জোনের সেক্রেটারি জেনারেল মাহমুদুল হক পেয়ারু ইনকিলাবকে বলেন, এক লাখ টাকা দিয়েও সিট পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বিমান তো নিচ্ছেই না। অন্যান্য এয়ারলাইন্সও সিট দিচ্ছে না। তাহলে এখন আমাদের যে মানুষগুলো ছুটিতে দেশে এসেছে বা আটকে গেছে বা ভিসার সময় বাড়িয়েছে, এ মানুষগুলো কর্মস্থলে যেতে না পারলে বাংলাদেশের যে কত বিশাল ক্ষতি হবে। সরকারকে তা চিন্তা করতে হবে। বিশ্বজুড়ে শ্রম বাজার খুলে যাওয়ায় গত দুই মাস ধরে টিকিটের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম টিপু সুলতান ইনকিলাবকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যগামী হাজার হাজার কর্মী বিমানের টিকিট না পেয়ে তাদের ভিসা ও ছুটির মেয়াদ শেষ হবার উপক্রম। বিদেশের কর্মস্থলে দ্রুত পৌঁছতে ওপেন স্কাই ঘোষণা করে ফ্লাইট সঙ্কট নিরসন করতে হবে। এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের ভাড়া দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়িয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিমানসহ মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্স গুলোর ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে জনশক্তি রফতানি খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বিমান টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতা ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সম্প্রতি বায়রার সাবেক সভাপতি আলহাজ আবুল বাসার ও সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, সিন্ডিকেট চক্র বিমানের টিকিট বøক করে বিদেশগামী কর্মীদের কাছে গলাকাটা হারে ভাড়া আদায় করছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বিমানকে অনুসরণ করে ভাড়া বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। ফ্লাইট সঙ্কটের দরুন প্রায় ৫০ হাজার বিদেশগামী কর্মী কর্মস্থলে যেতে পারছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন