আধুনিক সভ্যতার দৈনন্দিন চলাফেরায় মুদ্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পারস্পারিক বিভিন্ন বস্তু বা পণ্যের হস্তান্তরে পণ্যের মূল্য হিসেবে মুদ্রার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।উমর (রা.) প্রথম ইসলামি মুদ্রার প্রচলন করেন এবং এতে বেশ কিছু ইসলামি শব্দ সংযোজন করেন। আর এটা করেন তার খিলাফতের ৮ম বর্ষে অর্থাৎ ২০ হি. (৬৪১ খ্রি.) সনে। তিনি পারস্য সম্রাট কায়সারের ‘দিরহামের’ আকার আকৃতির অনুরূপ মুদ্রা তৈরির জন্য নির্দেশ দেন এর ওপর খলিফার নাম, তৈরির স্থান ও তারিখ লিখা হয়। তবে কোনোটির ওপর অতিরিক্তভাবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ কোনোটির ওপর ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ কোনোটির ওপর কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু’ এবং কোনোটিতে ‘উমর’ লিখা হয়। তদ্রুপ দামেস্কে ‘ব্রোঞ্জে’র তৈরি মুদ্রাগুলোয় ‘জায়েজ’ এবং হেমসে তৈরি মুদ্রাগুলোয় ‘তাইয়েব’ কিংবা ‘ওয়াফি’ ইত্যাদি শব্দ সংযোজন করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সঠিক ওজন নির্দেশ করা।”
ইসলামি মুদ্রা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। এরপর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদিন তা পূর্ণতা দান করেন এবং উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময় মুদ্রাব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে এবং তিনি প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থায় পূর্ণ ইসলামি মুদ্রা চালু করেন। এ পর্যায়ে দিরহামের ওজন স্থিতিশীল করা হয়। কারণ ইতঃপূর্বে দিরহামের ওজন বিভিন্ন রকম ছিল। কেন না সে সময় রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে মুদ্রাব্যবস্থা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত হয়। অতঃপর পৃথিবীতে ইসলামের আলো উদ্ভাসিত হলে পর্যায়ক্রমে পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান হতে থাকে।
মাওয়ারদী উল্লেখ করেন, উমর (রা.) যখন দিরহামের পরিমাণের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখেন যেমন-বাগালি দেরহামের পরিমাণ ছিল আট দাওয়ানেক এবং তাবারি দিরহামের পরিমাণ ছিল চার দাওয়ানেক, মাগরেবি দিরহামের পরিমাণ ছিল তিন দাওয়ানেক আর ইয়েমেনি দিরহামের পরিমাণ ছিল এক দাওয়ানেক। তিনি বলেন, ‘তোমরা লক্ষ্য কর, কোন মুদ্রা বেশি ব্যবহৃত হয় এবং অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে। অতঃপর দেখা যায়, বাগালি দিরহাম এবং তাবারি দিরহাম সর্বাধিক ব্যবহার হয়। তিনি ওই দুটি মুদ্রা একত্র করেন এবং তা ১২ দাওয়ানেকে পরিণত হয়। তিনি এর অর্ধেক ছয় দাওয়ানেক গ্রহণ করে ‘ইসলামি দিরহাম’ ছয় দাওয়ানেক প্রচলন করেন।
ইমাম আবু উবায়েদ বলেন, ‘উমাইয়া যুগে যখন মুদ্রা তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় তখন এর পরিণতি কী হবে তার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। অতঃপর যখন মুদ্রা তৈরির জন্য সবাই সম্মত হন তখন পূর্ণ দিরহামের বিবেচনা করা হয় আর এর পরিমাণ ছিল আট দাওয়ানেক, এর চেয়ে ছোট দিরহামের পরিমাণ ছিল চার দাওয়ানেক। অতঃপর তারা ছোট ও বড় উভয় ধরনের মুদ্রাকে সমমুদ্রায় পরিণত করেন এবং দুটি মুদ্রাই ছয় দাওয়ানেক করে তৈরি করা হয়। খলিফা উমর (রা.) স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রার পরিবর্তে পশুর চামড়ার মুদ্রা প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য মুদ্রা বহন সহজসাধ্য করা।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামি দিনার তৈরি করেন এবং তিনিই প্রথম ইসলামি মুদ্রা প্রচলনের পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং তিনিই সমগ্র পৃথিবীতে প্রধান ও প্রথম মুদ্রা তৈরি ও প্রচলনকারী হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন। আধুনিক পরিভাষা অনুযায়ী ‘ইসলামি দিনার’ তখনকার ‘হার্ড কারেন্সি’তে পরিণত হয়েছিল।উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে ৭৭ হিজরী মোতাবেক ৬৯৬-৯৭ ঈসায়ীতে প্রথম সফলভাবে ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থার সূচনা করা হয়। তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যের মুদ্রা ব্যবস্থাকে নতুনভাবে প্রবর্তন করেন। আবদুল মালিক স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় প্রকার মুদ্রারই নির্দিষ্ট মানদন্ড নির্ধারণ করেন। নতুন নকশায় তিনি এই মুদ্রাসমূহ মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রচলন করেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রার নামকরণ করেন দিনার। লাতিন শব্দ দিনারিয়াস থেকে দিনার শব্দটির আগমন যার অর্থ স্বর্ণ। অপরদিকে রৌপ্যমুদ্রার নাম হয় দিরহাম যা পারসিক দ্রাখম থেকে নামকরণ করা হয়।
এই ইসলামী মুদ্রাগুলোর নকশায় ধর্মের সংযোগ ছিলো স্পষ্টতর। মুদ্রাগুলোর একপিঠে ছিলো কুফিক লিপিতে কালেমা শাহাদাতের নকশা। এর অপরপিঠে ছিলো সূরা তওবার ৩৩ নং আয়াতের নকশা। তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন।
প্রাথমিক ইসলামী মুদ্রাসমূহের এই নকশা এবং মানদন্ড অব্যাহত থাকে পরবর্তী একহাজার বছর। পরবর্তী এক হাজার বছর একই মানদন্ড ও নকশায় ইসলামী মুদ্রা তৈরি হতে থাকে।ইসলামি মুদ্রা তৈরি ও প্রচলনের কাজ প্রথম শুরু হয়েছে হজরত উমর (রা.)-এর সময়ে এবং এর পূর্ণতা ঘটেছে আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আমলে। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এটাই পরিষ্কার হলো যে, হিজরির প্রথম শতাব্দী সমাপ্তির আগেই ইসলামি মুদ্রা তথা ইসলামি স্বর্ণ মুদ্রা ‘দিনার’ এবং ইসলামি রৌপ্য মুদ্রা ‘দিরহাম’ গোটা পৃথিবীর প্রধান মুদ্রায় পরিণত হয়।
ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা মুসলিম সাম্রাজ্যের বাজার ব্যবস্থায় নিয়ে আসে এক নবতর পরিবর্তন। এই মুদ্রা মুসলিম বণিকদের অপরাপর জাতির সাথে অধিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করে এবং বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে আমাদের ইতিহাসের এই গৌরবজনক নিদর্শন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন