শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো ইবাদত

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১১:৫৭ পিএম

শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় শীতের তীব্রতা বেড়ে চলছে ক্রমে। কনকনে ঠাণ্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। অনেকের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শীত। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের অভাবী ও গরিব মানুষ। শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগও বর্ণনাতীত। শীতে অভাবী মানুষের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে শীতবস্ত্রের। করোনার কালো থাবা ও অভাবের কারণে অনেকের পক্ষে আলাদাভাবে শীতের কাপড় কেনা দুঃসাধ্য। জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে পড়ছে দিনমজুর, ভ্যানচালক, ইজিবাইক চালক, পাথর শ্রমিক, চা শ্রমিকসহ সাধারণ কর্মজীবি এবং ছিন্নমূল মানুষের। হিমহিম ভোরে কাজে যোগ দিতে দুর্ভোগে পড়ছেন খেটে খাওয়া মানুষজন। কাজে যেতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন তারা। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে চরের হতদরিদ্রদের কষ্ট হচ্ছে খুব। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছে শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়স্করা। বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ-ব্যাধি। কোভিডের বিপদ ছাড়াও বাড়ছে সর্দি-কাশি, হাঁপানিসহ ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগ।
সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। নইলে সাধারণের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমেও এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। গ্রামাঞ্চলের বেড়ার ঘরে, জীর্ণশীর্ণ বস্তিতে কিংবা খোলা আকাশের নিচে উষ্ণ বস্ত্রহীন দুঃসহ রাত পার করতে হয় কতো মানুষকে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে এদের নিয়ে আমাদেরও ভাবতে হবে। শীতের পোশাক থাকাসত্ত্বেও নতুন আরেকটি পোশাক কেনার আগে অসহায় মানুষের শীতের কষ্ট উপলব্ধি করা উচিত। অন্তত পুরোনো পোশাক দিয়ে হলেও শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন। খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬৮২)।
দরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবসেবা। এটা সওয়াবের কাজও বটে। বদর যুদ্ধের বন্দী হজরত আব্বাস (রা.)-কে রাসুল (সা.) পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে মুদার গোত্র থেকে গলায় চামড়ার আবা পরিহিত বস্ত্রহীন কিছু লোক আগমন করলো। তাদের করুণ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.)-এর চেহারা বিষণ্ন হয়ে গেলো। তিনি নামাজ শেষে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে লক্ষ্য করে দান-সদকার জন্য উৎসাহমূলক বক্তব্য দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এতো অধিক পরিমাণ দান করলেন যে, খাদ্য ও পোশাকের দুটি স্তূপ হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে রাসুল (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অভাবীকে বস্ত্র দানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে কাপড় দান করলে যতোক্ষণ ওই কাপড়ের টুকরো তার কাছে থাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত দানকারী আল্লাহর হেফাজতে থাকবে।’ (তিরমিজি : ২৪৮৪)।
চলতি শীতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তা ছাড়া এ সময়ে শীতজনিত প্রাদুর্ভাব (যেমন সর্দি-কাশি, হাঁপানিসহ) নানা রোগে আক্রান্ত থাকে বেশির ভাগ মানুষ। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসা উচিত। প্রভাবশালী হাসপাতাল মালিকরা অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পের মাধ্যমে ফ্রি চিকিৎসা সহায়তা দিতে পারেন। কারণ মানুষের অসুস্থতার আপদ দূর করলে আল্লাহতায়ালা দুনিয়া-আখেরাতে তার বিপদাপদ দূর করে দেন। এই হাড়কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্ঠী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দীনি দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহতায়ালা তার আখেরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহতায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।
শীতের তীব্রতা খুব বেশি বেড়ে গেলে কিংবা টানা শৈত্যপ্রবাহ থাকলে আমরা শীতবস্ত্র বিতরণের প্রয়োজন অনুভব করি। অথচ দান করার ইচ্ছে থাকলে শীতের শুরুতেই অসহায়দের শীতের উপকরণ পৌঁছে দেওয়া উচিত। এতে শীতার্তদের কষ্ট লাঘব হয়। তা ছাড়া হাদিসে যথা সময়ে দ্রুত দান করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! কোন দানে সওয়াব বেশি পাওয়া যায়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘সুস্থ ও কৃপণ অবস্থায় তোমার দান করা, যখন তুমি দারিদ্র্যের আশঙ্কা করবে ও ধনী হওয়ার আশা রাখবে। দান করতে এ পর্যন্ত বিলম্ব করবে না, যখন প্রাণবায়ু কণ্ঠাগত হবে, আর তুমি বলতে থাকবে, অমুকের জন্য এতোটুকু, অমুকের জন্য এতোটুকু। অথচ তা অমুকের জন্য হয়ে গেছে।’ (বোখারি : ১৪১৯)। তাই এখনই সময়, শীতার্ত মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা। পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সরবরাহ করে সাধ্যমতো শীতার্তদের পাশে এসে দাঁড়ানো। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবধর্ম। এ মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত।
অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। সুতরাং নামাজ-রোজার সঙ্গে কল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই। তবে পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব এবং নবীদের প্রতি ইমান আনলে। আর আল্লাহপ্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থীদের এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে। সর্বোপরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থ-সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)।
প্রতি বছর শীত এলে অভাবীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা উচ্চারিত হয়। অনেক জায়গায় এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কিন্তু ব্যতিক্রম যা ঘটছে, তা সাধারণভাবে চোখে পড়ার মতো নয়। তা হলো, প্রতি বছর সমাজের সামর্থ্যবান জনদরদি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্বল, শীতবস্ত্র, খাবার ইত্যাদি গ্রামে গ্রামে দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করে থাকেন। তরুণ-যুবকরা মহল্লায় মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে। পরে তা গরিবদের মাঝে বণ্টন করে থাকে। শীত এলে এসব ছিলো চিরচেনা সামাজিক কর্মকাণ্ড। এবার সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আমেজ খুব একটা চোখে পড়ছে না। জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ- এসব ধারণার সঙ্গে মানুষের একাত্মতার বোধ শিথিল হয়ে পড়েছে। তাই শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষের কষ্ট লাঘবে আগের মতো সবার এগিয়ে না আসার পেছনে এটিই কারণ বলে ধারণা। তবু বসে থাকলে চলবে না। দরিদ্র, অভাবী ও বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। এটাই মানব-মানবতা ও ইসলামের দাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মুহাম্মাদ মহাসিন ৭ জানুয়ারি, ২০২২, ১১:০০ এএম says : 0
লেখাটি পড়ে অনেক ধারনা হলো। ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন