মানবজীবনকে প্রবাহমান নদীর সাথে তুলনা করা হয়। নদীর বহতা যেমন থেমে না, তেমনি মানবজীবনের কোনো মুহূর্তই স্থির থাকে না। এর ক্ষয় আছে, আছে নিঃশেষ ও পরিসমাপ্তি। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ- ‘সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ জীবন থেকে সময় একবার অতিক্রান্ত হলে তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে নতুন ও অভিনব অনেককিছু আবিষ্কৃত হলেও সময়কে ধরে রাখার মতো কোনো যন্ত্র এখনো তৈরি হয়নি। এজন্য মানুষের জীবনে সময়ের গুরুত্ব ও মূল্য সবচেয়ে বেশি। জীবনকে সার্থক করতে হলে সময়ের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। সময়ের শপথ করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্য ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’- সূরা আসর : ১-৩
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো- ‘ভাগ্যবান কারা? তিনি বললেন, ভাগ্যবান তারা, যারা দীর্ঘায়ূ লাভ করেছে এবং তা নেক আমলের মাধ্যমে অবিবাহিত করেছে। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো- দুর্ভাগা করা তিনি বললেন, দুর্ভাগা তারা, যারা দীর্ঘায়ূ পেয়েছে এবং তা বদ আমলে কাটিয়েছে বা আমলবিহীন অতিবাহিত করেছে।’- সুনানে তিরমিজি : ২৩২৯
অনন্তকালের এক জীবন- পরকাল। পরকালের পাথেয় সংগ্রহের একমাত্র জায়গা দুনিয়া। পরকালীন সুখ-শান্তি ও দুঃখ-কষ্ট নির্ভর করে দুনিয়াতে মানুষের কাজকর্ম ও জীবনাচার। মানুষের সৃষ্টি এবং তাকে দুনিয়াতে পাঠানো কোনো নিরর্থক বিষয় নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য যোগাবে। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা জীবিকাদাতা, শক্তির আধার, পরাক্রান্ত।’- সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬-৫৮
নির্দিষ্ট একটি গণ্ডি ও সীমারেখার মধ্যে থেকে মানুষকে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করতে হবে। দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ আলোচনায় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বৈ তো কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত।’- সূরা আনকাবুত : ৬৪
‘তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি।’- সূরা হাদিদ : ২০
‘প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলাপ্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।’- সূরা আল-ইমরান : ১৮৫
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে থাকে যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী। আর তুমি নিজেকে একজন কবরবাসী বলে গণ্য করবে।’
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের অপেক্ষা করো না, আর যখন তুমি সকালে উপনীত হবে তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও এবং মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে মূল্যায়ন করো।’- সহিহ্ বোখারি : ৬৪১৬
দিন, মাস ও বছর শেষে মানুষ অনেককিছুর অংক কষে। বিগত সময়ের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব করে আগামী দিনের পরিকল্পনা আঁকে। বৈচিত্রময় এ দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহ এবং দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক সময় মানুষকে আল্লাহর ভয়, মৃত্যুর স্মরণ ও আখেরাতের ভাবনা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। মুমিনের জীবন কখনো এমন হতে পারে না। আল্লাহর স্মরণ ও মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কল্পনা মুমিনহৃদয়কে সবসময় জাগরুক রাখে। আল্লাহতায়ালা মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন, ‘মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্য সে কী প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহতায়ালাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা করো, আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।’- সূরা হাশর : ১৮
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিমি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।’- সূরা মুলক : ২
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের জীবনের প্রত্যাশা করে সে পার্থিব শোভা সৌন্দর্য পরিহার করে।’- সুনানে তিরমিজি : ২৩৮২
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার পূর্বে গনিমত মনে করো; বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্রের আগে স্বচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’- সুনানে বায়হাকি : ১০২৪৮
অন্য এক হাদিসে এরশাদ হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন বনি আদমকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পা আগে সরাতে দেওয়া হবে না- তার জীবন কিসে নিঃশেষ করেছে, যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে, কোন পথে আয় করেছে, কোন খাতে ব্যয় করেছে এবং জ্ঞান অনুযায়ী কতটুকু কাজে পরিণত করেছে?’- সুনানে তিরমিজি : ২৪১৬
দুনিয়াতে মানুষের বেচে থাকতে হলে আহার্যের প্রয়োজন রয়েছে। আর এ জন্য জীবিকা উপাজর্নের বিভিন্ন মাধ্যম তাকে গ্রহণ করতে হয়। এটা দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম। আল্লাহকে স্মরণ রেখে বৈধ পন্থায় জীবিকা উপার্জনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’- সূরা জুমআ : ১০
আল্লাহর ভয়, মৃত্যুর স্মরণ ও আখেরাতের ভাবনা মানুষের পার্থিব ও পরকাল জীবনকে স্বার্থক করে তোলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার সকল চিন্তাভাবনা একমাত্র আখেরাতের চিন্তায় বিলীন করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার দুনিয়ার সকল চিন্তার ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’- সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩৩০
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে বনী আদম, তুমি আমার ইবাদতের জন্য সকল প্রকারের ঝামেলা থেকে মুক্ত হও, তাহলে আমি তোমার অন্তর প্রাচুর্যপূর্ণ করে দেবো।’- সুনানে তিরমিজি : ২৪৬৬
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন