নির্বাচনের ঘোষণা আসলে দুই দলের চেহারাই পাল্টে যাবে
ক্ষমতাসীনদের অপকর্মই ভোট ব্যাংক সৃষ্টি করেছে
আফজাল বারী : ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারী দলের কর্মকৌশলের পাশাপাশি নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করছে বিএনপির হাইকমা-। এর অংশ হিসেবে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে দ্রুত গতিতে। নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে প্রার্থী তালিকার গুডবুকে নিজের নাম লেখাতে দৌড়ঝাঁপ করছেন সম্ভাব্যরা। আর দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সরকার যাদের নির্বাচনের বাইরে রাখতে সাজা দিতে পারে সেখানে ক্লিন ইমেজের একাধিক বিকল্প প্রার্থী খুঁজছে ‘দলীয় সার্চ কমিটি’।
অতীতের মতো সরকারের ‘চর’দের প্ররোচনায় ভোটের আগে আন্দোলনের নামে ‘ফাঁদে’ পা দেবে না দলটি। কারণ, নির্বাচনে জেতার জন্য এখন আর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। এক সময় এটির প্রয়োজন ছিল। ক্ষমতাসীনদের অপকর্মই ভোট ব্যাংক সৃষ্টি করেছে বলে বিএনপিপন্থী বোদ্ধাগণ মনে করেন।
নির্বাচনে প্রস্তুতি সম্পর্কে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, এ দলে নির্বাচনের প্রার্থী দিতে কোনো সমস্যা বা সঙ্কট হয়নি, হবেও না। আমরা চাই ভোটার নির্বিঘেœ যেনো তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, মানুষ ভোট দিতে পারবে, এমন নির্বাচনের জন্য বিএনপি সবসময়ই প্রস্তুত। আগামীকাল নির্বাচন হলেও বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারবে, প্রার্থী খোঁজা লাগবে না। আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, যে সরকারই হোক, যার অধীনেই নির্বাচন হোক সবার আগে প্রয়োজন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। আমরা সে দাবিটাই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
চলতি দশম জাতীয় সংসদকে মেনে নিচ্ছে না বিএনপি ও তার মিত্ররা। তাই দীর্ঘদিন ধরেই তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবির সাথে সায় দিচ্ছে দেশ-বিদেশের অনেকেই। যদিও বিএনপির দাবিতে থোড়াই কেয়ার করছে না ক্ষমতাসীনরা। তারা বলছে, নির্বাচন হবে সেটি নির্ধারিত সময়ে। আবার কেউ কেউ মধ্যবর্তী নির্বাচনের বুলিও ছাড়ছে। বিএনপি নেতারা এই আলোচনাকে উদ্বেগ ও শঙ্কাজনক বলে মন্তব্য করেছেন। এই আলোচনার ডালপালা কেটে দিয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচন হবে যথা সময়ে। সম্প্রতি দল পুনর্গঠন ও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পর সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে, ভোটারদের দ্বারে যেতে হবে। ভোটের মাধ্যমে আবার বিজয়ী হতে হবে।
বিএনপি ও তাদের মিত্র দলের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের অন্তরালে ভালো কিছু দেখছেন তারা। অর্থাৎ সামনে আরেকটি নির্বাচন। এই হিসেব-নিকেশ থেকে বিএনপিও তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করছে। দুই ধাপে কাজ করছে দলের কয়েক স্তরের নেতারা। প্রথমত, দল ও দলের বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। সরকারের নেতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে একই সাথে মানুষের প্রত্যাশা কী সেটিও আমলে নিয়ে তারা আগামী নির্বাচনের ইশতেহার প্রণয়ন করছেন। এ কমিটির তত্ত্বাবধান করছেন দলীয় প্রধান নিজেই। দ্বিতীয়ত, দল পুনর্বিন্যাস কাজকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের তত্ত্বাবধানে এই কর্মের গতিও অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর হাত দিয়েছেন তৃণমূল পুনর্গঠনে।
দলের ভাইস-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে জেলা কমিটি চূড়ান্ত করণের কাজ অনেক দূর। এরপরই উপজেলা/থানা, ইউনিয়ন/পৌরসভা ও ইউনিট কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়াও দলের ১১ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের বিষয়টি বিএনপি প্রধান নিজেই দেখভাল করছেন। এর অংশ হিসেবে মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক ও মুক্তিযোদ্ধা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছেন। অপেক্ষমাণ আছে যুবদল, কৃষকদল, তাঁতীদল, জাসাজ। সব শেষে ছাত্র দলের কমিটি ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন এমন নেতাদের মতামতের প্রাধান্য দিয়ে সকল কমিটি অবশ্যই নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে বলে খোদ দলীয় প্রধান নির্দেশনা দিয়েছে।
বিএনপির কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন দায়িত্বশীল নেতা ইনকিলাবকে জানান, প্রার্থী বাছাইয়ে চূড়ান্ত রূপ দিতে বিএনপি দু’টি ফর্মুলা নিয়ে কাজ করবে। প্রথমত, বিএনপির সম্ভাব্য যেসব প্রার্থীকে সরকার নানাভাবে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার চেষ্টা করবে সেখানে এখন থেকেই কয়েকটি ধাপে বিকল্প প্রার্থী প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, যেখানে বিএনপির প্রার্থীর পরাজয়ের শংকা থাকবে সেখানে বিকল্প শক্তিশালী প্রার্থী বাছাই করা। তিনি জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপিতে অনেক নতুন মুখও দেখা যাবে। সমাজের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হিসেবে যারা সুপরিচিত; কিন্তু রাজনীতি করেন না, এমন অনেক ব্যক্তির হাতে ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেয়া হতে পারে। এদিকে প্রস্তুতির গতি দেখে সম্ভাব্য প্রার্থীরা হাইকমা-ের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে জোরেশোরে। মামলা, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাতে নেমেছেন। কর্মীদের খোঁজ-খবর রাখছেন।
নাম প্রকাশ না করে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র ইনকিলাবকে জানান, দলটির হাইকমান্ড মনে করে- সরকারের নেতিবাচক কর্মকা- সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা জন্ম নিয়েছে এবং যেভাবে ভেতরে ভেতরে বিএনপির ভোটব্যাংক তৈরি হয়েছে, তাতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি খুবই আশাবাদী। এখন শুধু জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে যা যা করার বিএনপি সেদিকেই এগোবে। সেক্ষেত্রে ভোটের আগে দলটি শুধু নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে। তারপরও শেষ পর্যন্ত যে কমিশনই আসুক বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকবে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ‘সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির’ বর্তমান চেহারা থাকবে না। অনেক কিছুই তখন পাল্টে যাবে বলে দলটি মনে করে প্রায় সকল স্তরের নেতাকর্মীরা।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করার মতো কোনো ফাঁদে আর পা দেবে না। কারণ, নির্বাচনে জেতার জন্য এখন আর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। এক সময় এটির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গোটা রাজনীতির চিত্র আওয়ামী লীগ বদলে দিয়েছে। এখন আর বিএনপিকে আন্দোলন করতে হবে না। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে দেখা যাবে। এছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণই সঠিক জবাব দেবে। তাই ভোটের আগে তারা আর কোনো শক্তি ক্ষয় করবে না, সব শক্তি নিয়ে বিএনপি ভোটের মাঠে সক্রিয় হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন