শফিউল আলম : জাতীয় অর্থনীতির হৃদপি- চট্টগ্রাম বন্দর ও বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদী। সেই খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কর্ণফুলীর এখন চরম মরণদশা। বেপরোয়া দখল-বেদখল, দূষণ ও ভরাটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদী। হুমকির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতা। সাড়ে ৫শ’ ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, দেশি-বিদেশি জাহাজ কোস্টার নৌযান ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য-ময়লা-জঞ্জাল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী নদী, নৌ-চলাচলের মূল (নেভিগেশনাল) চ্যানেল, বহির্নোঙ্গরসহ সমগ্র বন্দর এলাকা। ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছে নদীর পানি। ৬০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম নগরীর বিশাল অংশের বর্জ্যরে ঠিকানা কর্ণফুলী। বিলুপ্ত হচ্ছে মৎস্য সম্পদসহ এ নদীর হাজারো জীববৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, কর্ণফুলীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। দূষণের কবলে পড়ে এর মধ্যে মিঠা পানির প্রায় ২৮ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ১৬ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। আরও ২০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিপন্ন।
এদিকে বন্দর চ্যানেল ঘেঁষে কর্ণফুলী মোহনায় কমপক্ষে ১৫৮ একর ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। নির্বিচারে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কর্ণফুলীর উভয় তীরের অবৈধ দখল হওয়া জমি উদ্ধারে সরকারের তরফে বার বার আশ্বাস ব্যক্ত করা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। থমকে আছে ভূমি বেদখল মুক্ত করতে মোবাইল কোর্টের অভিযান। কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়কে কেন্দ্র করে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। এ জমির বাজার মূল্য ৩শ’ ৮৫ কোটি টাকা।
সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের দাপট দেখিয়ে সারি সারি বাড়ি-ঘর বানিয়ে কর্ণফুলীর তীরভূমি বেদখল করা হয়েছে। এর পেছনে তৎপর রয়েছে একেকটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্র। কথিত সমিতির নামে প্লট বেচাকেনা চলছে। প্লটের ব্যবসায় অপরিকল্পিতভাবে বালি তোলার কারণে কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হচ্ছে। চাক্তাই রাজাখালীর দু’পাশে, চর পাথরঘাটা, সিডিএ মাঠ, ওমরআলী ঘাট, মনোহরখালী এলাকার কাছে নতুন চরের জমির দাবিদার সেজে, আবার অনেকে নদীর বালি তুলে ও ডুবোচর ভরাট করে কর্ণফুলী দখলে মেতে উঠেছে। এ নিয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ অপরাধমূলক কর্মকা- মাথাচাড়া দিয়েছে।
কর্ণফুলী নদী গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া জানান, কর্ণফুলীর রয়েছে আলাদা কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান। এগুলো ঠিক রেখে কর্ণফুলী রক্ষার জন্য নদীর তীররেখা চিহ্নিত করা এবং তীর বাঁধানো এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কর্ণফুলী বাঁচলেই বন্দর বাঁচবে। এর উভয় তীরের নগরায়নের ধারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। কাপ্তাইয়ে রয়েছে পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্প। নদীটির দুই তীরজুড়ে ৮৫ লাখ মানুষের বসবাস। বিস্তার লাভ করেছে বিশাল সওদাগরী পাড়া। সভ্যতার মেলা। প্রকৃতির অপার দান কর্ণফুলী। এ নদীটি মানুষকে সবই দিয়েছে উদারভাবে। অথচ সেই নদী দিন দিন ভরা যৌবন হারিয়ে ফেলেছে।
ভূমিদস্যুরা গ্রাস করে নিচ্ছে নদীতীরের জমি, পলিভূমি, সদ্য জেগে ওঠা চর, তলদেশের বালি-মাটি। চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৪টি খাল দিয়ে আবর্জনা নিষ্কাশন, দু’শ’ কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শত শত জাহাজের তেলবর্জ্য নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলী পরিণত হয়েছে অঘোষিত এক ভাগাড়ে। বিষিয়ে উঠছে নদীর পানি। বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা।
কর্ণফুলীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বন্দরের লাইটারেজ জেটির ঘাট ও জায়গাগুলো প্রতিনিয়ত নদীর বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা ও গতিপথ রক্ষায় নদীশাসন, নিয়মিত ড্রেজিং ও দূষণরোধ জরুরি হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা উপেক্ষিত। বরং জমির দাম বাড়ার সাথে সাথে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। চওড়ায় ও গভীরতায় নদী ছোট হয়ে আসছে। পানি প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা হারিয়ে বর্ষায় কাদা-পানির জোয়ারে ডুবে যাচ্ছে বন্দরনগরী এবং এর ব্যবসা ও শিল্পাঞ্চল। এককালে বন্দরের কর্মব্যস্ত বন্দর এলাকা ওমর আলী ঘাট, অভয়মিত্র ঘাটে, মনোহরখালী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও এপাশে চর জেগে নদী ভরাট ও মরা বন্দরে রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। জাপানি সহায়তায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ বছর আগে নির্মিত মনোহরখালী মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে এখন আর মাছের ট্রলার-নৌযান ভিড়তে পারে না। বন্দরের মূল ১নং জেটি অতিক্রম করে ক্রমেই পলিবালির আস্তর জমেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীকে অর্ধচন্দ্র আকারে বেষ্টন করে রেখেছে কর্ণফুলী নদী। তীরজুড়ে বিস্তীর্ণ ভূ-সম্পত্তির মালিক চট্টগ্রাম বন্দর। বিগত সময়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কঠোর সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধারে যে সাফল্য আসে, তারও কিছু কিছু ফের বেদখল হয়ে গেছে। কর্ণফুলী সংলগ্ন বন্দরের মূল্যবান জমি ইজারার আড়ালে হাতছাড়া করা হয়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে। নেপথ্যে বিপুল অংকের অর্থ অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। জোয়ারে প্লাবিত ভূমি থেকে ৫০ গজ দূর পর্যন্ত ‘পোর্ট লিমিট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি। কিন্তু গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। নদীর গতিপথ বদল ও নদী ভাঙনের সাথে মিল রেখে সঠিক ও নিয়মিতভাবে তীরভূমি রেখা কোথাও চিহ্নিত করা হয়নি। এর পুরো সুযোগ নিচ্ছে ভূমিগ্রাসী চক্র। আবার অনেকে অনুমোদনের আড়ালে জায়গা বাড়িয়ে অবৈধ কাঠামো বানাচ্ছে। যা কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন