শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দুর্নীতি ও বৈষম্যের কবলে মংলা বন্দর

প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা, খুলনা : মংলা বন্দরে শুল্ক কর জটিলতা কাটছে না। চট্টগ্রাম বন্দরে এক কন্টেইনার পণ্য খালাস করতে ব্যয় হয় মাত্র ৭ হাজার টাকা, সেই একই কন্টেইনার মংলা বন্দরে খালাসে ব্যয় হয় এক লাখ ১১ হাজার টাকা। কতিপয় অসাধু শুল্ক কর্মকর্তার অর্থ আদায়ের জবরদস্তিমূলক মনোভাবে এই চিত্র চলছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ কাস্টম কমিশনার এ অঞ্চলের লোক না হওয়ার কারণে নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেন। ফলে মংলা বন্দর থেকে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং মংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের দায়িত্বশীল সূত্রে জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কন্টেইনার খালাস করতে রাজস্ব ছাড়া উৎকোচ দিতে হয় ৭ হাজার টাকা আর সেই একই পণ্য খালাসে মংলা শুল্ক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হয় এক লাখ ১১ হাজার টাকার ওপরে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় এক কন্টেইনার পণ্য খালাসে মংলায় ঘুষ বেশি দিতে হয় এক লাখ ৪ হাজার টাকা। এই ঘুষের রেট ওপেন সিক্রেট। বাজার দরের সাথে এই ঘুষের দরও ওঠানামা করে।
মংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক লিয়াকত হোসেন অভিযোগ করেন, আমদানিকৃত পণ্যে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বন্দরে কেজি প্রতি ধরা হয় ৩ ডলার, অথচ মংলা বন্দরে তার দ্বিগুণ ৬ ডলার করা হয়। অতিরিক্ত মূল্য ধরার ব্যাপারে আমদানিকারকরা কাস্টম কমিশনারের কক্ষে গেলে তিনি বলেন, যে বন্দরে কম মূল্য ধরা হয় সেই বন্দরে গিয়ে ব্যবসা করেন। তিনি দাবি করেন, মংলা বন্দর ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কাস্টম কমিশনারের একগুঁয়েমি ও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ইতোমধ্যে অনেকেই এ বন্দর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে চলে গেছে।
কাস্টমসের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি একজন গ্লাস আমদানি কারকের পণ্য পরীক্ষণের সময় সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন ঘোষণার বাইরে অতিরিক্ত পণ্য আনার রিপোর্টে দেয়। কিন্তু ওই ব্যবসায়ির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরং কাস্টমস কমিশনারের লোক হওয়ায় পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়। একইভাবে বন্দর থেকে শুল্ক ছাড়াই অতিরিক্ত কাপড়বাহী একটি ট্রাক বন্দর গেট থেকে অতিক্রম করার সময় সহকারী কমিশনার ট্রাকটি চ্যালেঞ্জ করে পরীক্ষা করে দেখেন ঘোষণার বাইরে অতিরিক্ত প্রায় ৫ টন কাপড় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট ‘ট্রায়কম ফ্রেরড এন্ড লজিস্টিককে’ জরিমানা করে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেন। কিন্তু কাস্টমস কমিশনার সিএন্ডএফ এজেন্টে বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে পণ্য নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। একই সিএনএফ এজেন্টের মাধ্যমে খুলনার ফুলতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এন্ড এগ্রিকালচার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান  মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ বেল্ডার লবণ খালাস করে। এতে সরকারের দশ কোটি টাকা ফাঁকি দেয়া হয়। যা নিয়ে বর্তমানে কাস্টমস হাউজে তোলপাড় চলছে।
এ ব্যাপারে মংলা কাস্টম হাউসের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন হাজার হাজার বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয় আর সে স্থলে মংলা বন্দরে বছর মিলে হাজার হয় না। তাহলে তো রেট বাড়বেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আমদানিকারক এবং মংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট বলেন, সহকারী কমিশনার-এর কাছ থেকে পণ্য ছাড় না হলে তার ওপরে ফাইল গেলে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়।
এ ব্যাপারে মংলা কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার মোঃ মোহন মিয়া বলেন, তাদের কাছে কোন আমদানিকারক বা মংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট এই ঘুষের ব্যাপারে অভিযোগ দেয়নি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন এজেন্টরা ঘুষ দেয় কেন ? ঘুষ না দিয়ে, তো অভিযোগ করতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান নাজিবুর রহমান খুলনায় প্রাক বাজেট আলোচনায় আসলে খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি এড. সাইফুল ইসলাম সকলের উপস্থিতিতে এই ঘুষের হার বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ তোলেন। তিনি কতিপয় শুল্ক কর্মকর্তার মংলা বন্দরে যাতে ব্যবসায়ীরা না আসে সেই চক্রান্তে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। তিনি কয়েকজন শুল্ক কর্মকর্তার দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম করার কথা উপস্থাপন করেন। এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নাজিবুর রহমান বিষয়টি শুনলেও এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স এন্ড ডিলারস এসোসিয়েশন (বারবিডার) প্রেসিডেন্ট মোঃ আব্দুল হামিদ শরীফ খুলনায় এসে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, মংলা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের আচরণ ব্যবসাবান্ধব নয় বরং তারা অসহযোগিতামূলক আচরণ করছে। এই অসহযোগিতার কারণে তাদের মংলা বন্দর পরিত্যাগ করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। তিনি আরো জানান, গাড়ি আমদানির কারণে মূলত মংলা বন্দরটি আবার লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র কাস্টমস কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার জন্য সরকারের মংলা বন্দরের গতিশীল করার সদিচ্ছা ভূলুন্ঠিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি মংলা কাস্টম হাউসের কমিশনারদের আচারণকে দুঃখজনক বলে বর্ণনা দেন।
তিনি লিখিতভাবে জানান, প্রথমত, আইনির মারপ্যাঁচে ফেলে আমদানিকারকদের অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিনের অনুসৃত এইচএস কোড নিয়ে আপত্তি তুলে শুল্কায়ন জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তৃতীয়ত, শুল্কায়ন সংক্রান্ত কাজে গতি সঞ্চারের জন্য পদে পদে অর্থ আদায়ের ফাঁদ পাতা হয়েছে, ফলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। বারবিডার এই সংবাদ সম্মেলনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মংলা-রামপাল আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, মংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের পক্ষ হতে মংলা বন্দর এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষ এই হয়রানিমূলক কর্মকা-ের প্রতিবাদে খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন। খুলনা চেম্বার সভাপতি ব্যবসায়ীদের এই সমস্যা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে লিখিতভাবে জানিয়ে পত্র দেন। এই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, নৌ-পরিবহন মন্ত্রীকে মংলা সমুদ্র বন্দরের বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পত্র দিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা তার পত্রে উল্লেখ করেছেন যে শুল্ককর জটিলতা নিরসনসহ মংলা বন্দরকে গতিশীল করতে ৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থমন্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই পত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সমতা আনতে হবে। এজন্য মংলা বন্দরের পণ্য খালাস পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে তা অনুসরণ না হওয়ায় পণ্য খালাসে বিলম্ব, হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় আমদানিকৃত পণ্য চালানের কনটেইনার ভাড়া মংলা বন্দরে বেশি। তাই চট্টগ্রামের মত এ বন্দরের ভাড়া কম করা প্রয়াজন। আর এ বিষয়ে বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়। এই কমিটিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, (এনবিআর) মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, এফবিসিসিআই বা খুলনা চেম্বারের সভাপতি এবং খুলনা বিভাগীয় কমিশনারকে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই কমিটিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, বার্ল্ক পণ্য আমদানিতে ১৯/২০ হতে পারে। আমদানিকৃত মোট পণ্য ৫% কম বেশি হওয়ার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি আছে। এই কম বেশি পণ্য আমদানি হলে চট্টগ্রাম বন্দরে অতিরিক্ত পণ্যর ওপর ১০-২০% জরিমানা দিয়ে পণ্য খালাসের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মংলা শুল্ক কর্তৃপক্ষ ১০০-২০০% পুরা পণ্যের ওপর জরিমানা আদায় করে। এমনকি আইনের সর্বোচ্চ যে পরিমাণ জরিমানা করার বিধান রয়েছে তার চেয়েও বেশি জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। ফলে মংলা বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন ব্যবসায়ীদের এসব সমস্যা তুলে ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে চিঠি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে মংলা কাস্টম হাউজের কমিশনার আল আমিন প্রামাণিক বলেন, শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন কোন বৈষম্য নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি কেজি পণ্যের মূল্য ৩ ডলার ও মংলা বন্দরে ৬ ডলার এ ব্যবধান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সব পণ্যে এ ব্যবধানের অভিযোগ সঠিক নয়।







 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন