রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসীগুলোতে ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি বাড়ছে। মহানগরীর পাড়া-মহল্লার ফার্মেসীগুলোতে নিম্নমানের ওষুধের ছড়াছড়ি। মূল কোম্পানীর ওষুধের মতো হুবহু লেবেলে নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। মূল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে দাম কম হওয়ায় এসব ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। এতে করে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। রোগীর লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, অস্থিমজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নজরদারী না থাকায় নকল ওষুধ বিক্রির রমরমা ব্যবসা চলছে।
জানতে চাইলে মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধ মার্কেটের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির ঢাকা বিভাগের সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা শেখ ইউনুস আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, ওষুধের বাজারের অবস্থা এমন যে, কোন ওষুধটি আসল বা নকল তা বোঝা দুষ্কর। ভয়াবহতা এমনভাবে বাড়ছে ওই চক্রটির কাছে দিনে দিনে আমরা জিম্মি হয়ে পড়ছি। অল্প কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো মার্কেটের দুর্নাম হচ্ছে। আর কমিশনের বিনিমেয়ে অসাধু চিকিৎসকদের একটি চক্র প্রেসক্রিপশনে এসব ওষুধ লিখছে। চক্রটির সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসকের যোগাযোগ রয়েছে। প্রতিদিনই আমরা এই চক্রটির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডীন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সম্পর্কে বলেন, এই ওষুধ শরীরের যে রোগের জন্য খাওয়া হচ্ছে, তার কাজ হচ্ছে না। এতে টাকা গচ্চা যাচ্ছে। একই সঙ্গে রোগীর লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও অস্থিমজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সায়েদুর রহমান বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভয়াবহ অপরাধ। দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হলে এটি থামবে না। এতে রোগ তো সারেই না, উল্টো আরও জটিলতা বাড়ে।
দেশের শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেফ-৩। এর বাজার মূল্য প্রতি পিস ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। একটি চক্র হুবহু নকল সেফ-৩ তৈরি করে বিক্রি করছে একই দামে। আর ফার্মেসীগুলো নকল এ ওষুধটির ১৪টি ট্যাবলেটের এক প্যাকেট ক্রয়ই করছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। সুযোগ বুঝে ফার্মেসীগুলো গরিব ও পড়তে পারে না এ রকম রোগীর কাছে ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা করেই বিক্রি করে অতি মুনাফা করছে। শুধু মুনাফাই নয়; অতিরিক্ত লাভের আশায় ভেজাল ও নিম্নমানের এ বিষ খাইয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আরেক শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মার গ্যাস্টিকের ছয় টাকা দামের সেকলো-২০ মিলি গ্রাম বাজারে হুবহু নকল করে ৫০-৭৫ পয়সায় বিক্রি করছে। একইভাবে শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্টা ফার্মার অ্যাজমা ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যার জন্য ১৬ টাকা মূল্যের মনটেয়ার নকল করে মাত্র ২-৩ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, ১১ টাকা মূল্যের ন্যাপ্রোক্সেন আড়াই টাকা এবং ১৬ টাকা মূল্যের একমি ল্যাবরেটরিসের মোনাস-১০ ৩ টাকায় বিক্রি করছে। ফার্মেসী মালিকরাও মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে করোনা মহামারিতে বহুল ব্যবহৃত নামসর্বস্ব এসব ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে অধিক মুনাফা করছে। একই জেনেরিক নামের ওষুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করলেও একেকটির মান একেকরকম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদারকির অভাবেই নিম্নমানের ওষুধ দেদার বিক্রি হচ্ছে।
বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশি উৎপাদিত ওষুধের সুনাম ও চাহিদা বাড়লেও দেশের চিত্র ভিন্ন। ওষুধ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি অথচ দেশের বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল ওষুধে। সু-চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ভেজাল ওষুধ কিনে উল্টো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ওষুধের মান নিয়ে তাই প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। একশ্রেণির ওষুধ কোম্পানি বেশি মুনাফা লাভের আসায় তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ। এসব ওষুধ সেবন করে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে মারাও যাচ্ছে রোগী। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম লুৎফুল কবির ইনকিলাবকে বলেন, ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা গণহত্যার মতো অপরাধ করছে। না জেনে ওষুধ খেয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ এমন এক পণ্য, যার সঙ্গে জীবন-মৃত্যু জড়িয়ে। অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক সব ওষুধেই মিলছে ভেজাল। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নানান প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মতে, নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আইনও নেই বাংলাদেশে। এছাড়া ওষুধ খাতের দুর্নীতি, চিকিৎসকদের কমিশনের লোভ, আইন প্রয়োগের শৈথিল্য, প্রশাসনের নজরদারির অভাব, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত অসমর্থতা, দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ভেজাল ওষুধ বাজারজাতকরণের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন তারা।
মিজান নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগী বেঁচে থাকার অনন্ত আকুতি নিয়ে হাসপাতালে যায়। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী স্বজনরা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে আনে। কিন্তু রোগ সারে না। কারণ ওষুধটাই নকল। রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এমন ঘটনা একটি-দুটি নয়, বহু। প্রায়ই এমন অনেক নকল ওষুধ ধরাও পড়ে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নামমাত্র। তার মতে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দেখছি শাস্তি হিসেবে কারখানার মালিককে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা কারখানা সিলগালা করে দেয়া হয়। অথচ বহু মানুষকে হত্যার মতো অপরাধ করার পর এটি কী খুব লঘু শাস্তি নয়? নকল ওষুধ তৈরি করে যারা লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে তারা দুই লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে আবারও একই কাজে নেমে পড়ে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন দেশে ২৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বানাচ্ছে। যে কোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে হয়। কিন্তু একবার বাজারজাত করার পর সেই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে আর কোনো তদারকি হয় না। এই সুযোগেও অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ওষুধের মান কমিয়ে দেয়। অবশ্য মাত্র ৪ হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে সরকারের। ফলে বিপুল পরিমাণ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিএইচও) এর তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যে ওষুধ বিক্রি হয় তার শতকরা ১৫ ভাগ ওষুধ নিম্নমানের, ভেজাল বা নকল।
সূত্র মতে, রোগ সারানোর জন্য ওষুধ খাওয়া হয়। কিন্তু ইদানীং রোগ সারানোর জন্য ওষুধ নয়; কিছু ওষুধই হয়ে উঠেছে রোগের কারণ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। কারখানা বানিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা যা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনেক ফার্মেসি মালিক জেনেশুনেই রোগীর হাতে তুলে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। এ নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মাঝে মাঝে কিছু অভিযান ছাড়া খুব একটা দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।
দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে নকল-ভেজাল ওষুধের কারবার। বিভিন্ন বাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অতীতে এমন অনেক ভেজালকারী ও বিক্রেতা ধরা পড়েছে। চক্রটি দীর্ঘদিন আয়ুবের্দিক ওষুধ তৈরির ভুয়া লাইসেন্সে রীতিমতো কারখানা বানিয়ে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে ভেজাল ওষুধ বানাচ্ছে। ওষুধ তৈরির নিরাপদ স্থান হিসেবে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, ডেমরাসহ পুরান ঢাকার কিছু এলাকাকে বেছে নিয়েছে।
নকল-ভেজাল ওষুধ নিয়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইটের গুঁড়ার সঙ্গে নানা ধরনের রং ও কেমিক্যাল মিশিয়ে ওষুধ বানানো হয়। গ্রামে-গঞ্জে এ ধরনের ওষুধই নাকি বেশি বিক্রি হয়। কারণ নকল ওষুধে বিক্রেতাদের লাভ হয় অনেক বেশি। শুধু মুখে খাওয়ার ওষুধই নয়Ñ ইনহেলার, অয়েন্টমেন্ট বা ইনজেকশনের মতো ওষুধও নকল হচ্ছে। এমন উপাদান দিয়ে ইনহেলার তৈরি হয়েছে, যা উপকার তো করবেই না; বরং মারাত্মক ক্ষতি করবে।
বিভিন্ন সময়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাঈম গোলদার বলেন, অভিযানে জব্দ করা ওষুধের মধ্যে বেশিরভাগ হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন বিহীন ভেজাল ওষুধ। জনগণকে অবশ্যই ইনভয়েস নম্বর দেখে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হবে। ইনভয়েস নম্বর হলো ওষুধের সার্টিফিকেট। যে কোম্পানি থেকে ওষুধ ক্রয় করা হয় সে কোম্পানির ইনভয়েস ওষুধ ফার্মেসিকে সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে ফার্মেসিগুলো চাপের মুখে থাকবে। এতে নকল ওষুধের চাহিদা তারা দেবে না।
বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে ঢাকাসহ সারা দেশে একাধিক চক্র সক্রিয়। গত কয়েক বছরে মিটফোর্ডের বাজার থেকেই কয়েকশ’ কোটি মূল্যের ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন এলাকায় কারখানা বানায়। তবে তাদের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড। এখান থেকেই ভেজাল ওষুধ ছড়ায় সারা দেশে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ওষুধের মান, দাম, কোম্পানি ও ফার্মেসি নিয়ন্ত্রণে নজরদারি ও অভিযান চলছে। যে সব এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে সেখানে অভিযান বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এমডি এস এম শফিউজ্জামান বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন প্রতিরোধে আমরা নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়ে আসছি। এ ছাড়া নিয়মিত ড্রাগিস্ট, কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করছি।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. রশিদ ই-মাহাবুব বলেন, দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কার্যদক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন