মানুষ সামাজিক জীব।সমাজ ছাড়া চলতে পারে না সে এক মুহূর্ত ও । সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করা তার জন্মগত স্বভাব। একটি সমাজের সদস্যরা যতই ভালো মানুষ হোক,কল্যাণমূলক কাজের প্রতি যতই তাদের আগ্রহ থাকুক, তাদের মাঝে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।তবে এ বিবাদ নিরসন না হলে পরিবার,সমাজ- রাষ্ট্র, কোথাও শান্তি-শৃঙ্খলা থাকবে না; বরং বিদ্বেষের দাবানল ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্রই। বয়ে যাবে খুনখারাবির সয়লাব। এ ঝগড়া-বিবাদ পার্থিব উপার্জন,নিজের অধিকার আদায়ের জন্য যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে অন্যান্য কারণেও । ইসলাম বিবাদ নিরসন করতে উৎসাহিত করেছে।ঘোষণা দিয়েছে বিবাদ মীমাংসাকারীর জন্য মহাপুরস্কার।
হজরত আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)ইরশাদ করেছেন, আমি কি তোমাদেরকে নামাজ,রোজা ও সদকার চেয়ে উত্তম কাজ সম্পর্কে অবহিত করবো না? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন,(তা হচ্ছে,)পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন। কারণ,পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়া মানে দ্বীন বিনাশ হওয়া। (জামে আত-তিরমিজি : ২৫০৯)। প্রিয়নবি (সা.) বিবাদকারী উভয় পক্ষের সাথে ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করতেন। মীমাংসা করতেন তাদের বিরোধ ইনসাফের সাথে। ফলে সন্তুষ্ট হয়ে যেতো বাদী-বিবাদি উভয়পক্ষ।মীমাংসার সময় তিনি তাদের সদুপদেশ দিতেন:অপর ভাইয়ের অধিকার লঙ্ঘন করা এবং বাতিল দাবির উপর অটল থাকার ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের সতর্ক করতেন। শিক্ষা দিতেন তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের । ঘৃণাবোধ জাগ্রত করতেন তাদের অন্তরে-জাহেলি যুগের অনৈতিক দাবি-দাওয়া ও নোংরা স্বজনপ্রীতির প্রতি। ফলে মুসলিম সমাজ ক্রমান্বয়ে একটি কল্যাণমূলক সমাজে পরিনত হয়।
এখানে প্রিয়নবী (সা.) এর কয়েকটি ফয়সালা- পদ্ধতি তুলে ধরা হলো- (১) আপোস করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা : বিবাদমান একপক্ষকে তাদের দাবি ছেড়ে দিয়ে আপোষ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। হজরত কাব বিন মালেক (রা.)থেকে বর্ণিত, তিনি মসজিদের ভেতরে ইবনে আবি হাদরাদ থেকে তাঁর পাওনা ঋণ দাবি করলেন। তখন তাদের উভয়ের আওয়াজ উচুঁ হয়ে উঠলে রাসূল সা. শুনতে পেলেন । তিনি তাঁর ঘরেই ছিলেন। তিনি তাদের দিকে দ্রুত ছুটে আসলেন, যার ফলে তাঁর ঘরের পর্দা উন্মুক্ত হয়ে গেল।
এসেই তিনি ডাক দিলেন, হে কাব! তিনি বললেন, আমি হাজির ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমার পাওনা ঋণ থেকে এ পরিমাণ-ইশারা করে অর্ধেক দেখালেন, ক্ষমা করে দাও। কাব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি ইতিপূর্বে তা করেছি। তখন রাসূল (সা.) (আবু হাদরাদকে) বললেন, তাহলে বাকিটা পরিশোধ করে দাও (সহিহ বুখারি : ৪৫৭)।
(২) ঋণ ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা: আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) দরোজার পাশে দুই ঝগড়াকারীর উঁচু আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাদের একজন অপরজনের কাছে ঋণ মাফ করে দেওয়ার আবেদন করছিলেন এবং তার প্রতি নম্রতা অবলম্বনের অনুরোধ করছিলেন। আর অপরজন বলছিলেন আল্লাহর কসম, আমি তা করবো না। তখন রাসূল (সা.) তাদের নিকট গিয়ে বললেন:কে সেই ব্যক্তি, যে নেক আমল করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম খেয়েছে। তখন লোকটি উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিই (সেই হতভাগা)। তবে এখন তার জন্য তা-ই হবে, যা সে পছন্দ করে। (অর্থাৎ তার অনুরোধ আমি মেনে নেবো)। (সহিহ বুখারি : ২৭০৫)।
(৩) মীমাংসা করা সম্ভব না হলে ফয়সালা করা : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন,জনৈক আনসারি নবিজি (সা.) এর সামনে জুবায়ের (রা.) এর সঙ্গে হাররার নালার পানির ব্যাপারে ঝগড়া করলো,যে পানি দ্বারা তারা খেজুর বাগান সেচ দিতেন। অতপর তাঁরা উভয়জন নবিজি (সা.) এর নিকট এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলে আল্লাহর রাসূল (সা.) জুবায়ের (রা.) কে বললেন, হে জুবায়ের! প্রথমে তোমার জমি সেচ করে নাও। এরপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও। এতে আনসারি ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়ে বললো, সে আপনার ফুফাতো ভাই বলে এমন ফয়সালা করেছেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেহারায় অসন্তুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ পেলো। এরপর তিনি বললেন,হে জুবায়ের! তুমি নিজের জমি সেচ করো। এরপর পানি আটকে রাখো, যেন তা বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। হজরত জুবায়ের (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম,আমার মনে হয় এ আয়াতটি এ সম্পর্কেই নাজিল হয়েছে: আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদের বিচার আপনার উপর অর্পণ করবে না। (সূরা নিসা: ৬৫; সহিহ বুখারি : ২৩৬১)। আজ শরয়ি বিচার নেই বলেই সমাজে এতো অন্যায়,এতো জুলুম! আল্লাহ আমদের কোরআন-সুন্নাহ মুতাবিক বিচার করার তাওফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন