বাড়তি খরচের চাপ থেকে বের হতেই পারছে না সাধারণ মানুষ। ক্রমেই বেড়ে চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম। চাল, ডাল, তেল, চিনি, ডিম, মাছ, গোশতের মতো পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া। এরপর ভরা মৌসুমেও শাকসবজির দাম নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। শুধু কাঁচাবাজারই নয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহস্থালি পণ্য, ওষুধপত্র, রান্নার গ্যাসসহ প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। মানুষের যাতায়াত খরচও বেড়েছে আগের তুলনায়। সামগ্রিকভাবে বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন চাহিদার তুলনায় কম বাজার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে পুষ্টি সমস্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার রোধে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এতে আবারও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধীর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে কাজের সুযোগও কমতে পারে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাজার বিশ্নেষকরা বলছেন, কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা আছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক ধরনের শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম ও পরিবহন খরচ। করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে সারাবিশ্বেই ভোগ্য ও শিল্পপণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে দাম বেড়েছে। এ ছাড়া আরেকটি কারণ হলো, জাহাজসহ অন্যান্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি। জাহাজ ভাড়া যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্য সরবরাহে বেশি সময়ও লেগেছে। তবে এসব কারণে যতটুকু বাড়া উচিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি বাড়ছে। এর মানে ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। আবার কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই। যেমন ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে। কোনো সবজিই এখন স্বাভাবিক দামে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পৌষ, মাঘ মাসে শীতকালীন সবজির দাম কম থাকে। অন্যদিকে এ সময় খালবিল, ঘের শুকিয়ে আসায় মাছের সরবরাহ বেড়ে দামও কমে যায়। এ বছর সরবরাহ বাড়লেও দাম কমছে না। কয়েকবার বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। এখন আবার বাড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে প্রতি কেজি মোটা চাল মানভেদে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে এ ধরনের চালের দাম প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়েছে। সরু চালের দাম এক বছরের ব্যবধানে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও মাঝারি মানের চালের দাম ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। এখন আমন ধানের মৌসুম। এ সময় চালের দাম কম থাকার কথা, অথচ বাজার পরিস্থিতি তা বলছে না। অন্যদিকে, আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত। আটা-ময়দা থেকে তৈরি বেকারি পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। খোলা সয়াবিন তেল বর্তমানে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। প্রতি লিটার পাম অয়েলে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি। মানভেদে ডালের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, গরম মসলা, লবণ সবগুলোরই দাম বেড়েছে। শীতের সবজির দাম অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি।
ডিটারজেন্ট, পেস্ট, সাবানসহ অন্যান্য টয়লেট্রিজের দামও গত বছরের চেয়ে বেশি। এদিকে করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও বেড়েছে লেখার কাগজের দাম। প্রতি দিস্তা লেখার কাগজ কোম্পানিভেদে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেচাকেনা হচ্ছে, যা আগের বছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডালের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে আগে থেকেই প্রস্তুতি না থাকলে সরবরাহে টান পড়ে। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডালের দাম নিম্নমুখী। যে কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য আমদানিতে তেমন এলসি খুলছেন না। অন্যদিকে, মজুদও গত বছরের তুলনায় কম। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল ও চিনি পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীদের রমজান উপলক্ষে এখনই পণ্য কিনে রাখার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে জাহাজ ভাড়া আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশ অভিমুখী জাহাজের ভাড়া বেড়েছে। বেড়েছে অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচও। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর দেশে ট্রাকের ভাড়া বেড়েছে। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবুল কাশেম সমকালকে বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় আগের তুলনায় বর্তমানে ট্রাক ভাড়া পণ্যের পরিমাণ ও দূরত্ব ভেদে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, ট্রাক ভাড়া বেড়েছে আরও বেশি।
অন্যদিকে আমদানি বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের বাজারে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এক ডলার পেতে ব্যবসায়ীদের এখন ৮৭ টাকা দিতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটিই ডলারের সর্বোচ্চ মূল্য। মূল্যস্ম্ফীতি নির্ভর করে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের ওপর। আমদানি পণ্য ভোক্তা মূল্যসূচকের উল্লেখযোগ্য অংশ হওয়ায় আমদানি পণ্যের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে। যাকে বলা হয়, কস্ট পুশ ইনফ্লেশন’। টাকার বিনিময় হারে এ ধরনের চাপ সৃষ্টি হওয়ায় মূল্যস্ফীতিতেও চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত ডিসেম্বর মাসে মজুরির হার বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, যা গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষের বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে জিনিসপত্রের দাম। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে যারা ঋণগ্রস্ত, তাদের অনেকেই বাড়তি আয় করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন