ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : আশানুরূপ হারে বিকশিত হচ্ছে না অমিত সম্ভাবনার প্লাস্টিক পণ্যের শিল্প। এজন্য সরকারের প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার অভাবকে দায়ী করেছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, সরকারের প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে গার্মেন্ট খাতের চেয়েও বড় হবে এই শিল্প।
গার্মেন্ট পণ্যের বিশ্ববাজার ৪০৩ বিলিয়ন ডলারের। সেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ ৫৯০ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ৯ কোটি ডলারের। এ হিসাবে বিশ্ববাজারে প্লাস্টিকের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ উৎপাদন খুব কম। এদিকে বিশ্বে মাথা পিছু প্লাস্টিক ব্যবহার হয় ২০ কেজি। ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১৪ কেজি। আর বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে ব্যবহার ৭ কেজি। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব ব্যবহারে থেকে ১৩ কেজি পিছিয়ে আছে। বিশ্ব রপ্তানির পাশাপাশি বাংলাদেশের বাজারেও প্লাস্টিক ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভবনায় খাত প্লাস্টিক পণ্য।
এদিকে কাঁচামালে আমদানি নির্ভরতা আর উৎপাদনে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার না হওয়ায় বিকশিত হচ্ছে না সম্ভাবনার প্লাস্টিক শিল্প। প্লাস্টিকের কাঁচামাল উৎপাদিত হয় পেট্রোকেমিক্যাল থেকে। বাংলাদেশে গ্যাসের বিপুল মজুদ থাকার পরও দীর্ঘ ৪০ বছরেও কোন প্লাস্টিক কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানা গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল ম্যানুফ্যাকচার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: আবু মোতালেব জানিয়েছেন, কাঁচামাল তৈরীর কারখারার বিষয়ে অনেক বছর ধরেই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন তারা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাচ্ছেন না। শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনেকবার চিঠি পাঠিয়েছেন বলেও তিনি জানান।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকারের নীতি সহায়তা পেলে ২০২১ সালের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে ৮ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
সরাসরি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে গত দশ বছরের ব্যবধানে চার গুণে বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে এ খাত থেকে। তবে বিশ্ববাজারে প্লাস্টিকে যে পরিমাণ চাহিদা বেড়েছে, তারা তুলনায় একবারেই সীমিত। ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ২২ মিলিয়র ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে ৯২ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপিতে প্লাস্টিক খাতের অবদান আছে ১ ভাগ অবদান রয়েছে। প্লাস্টিকের চাহিদা বিশ্ব বাজারে অনেক বেশি থাকায় ২০২০ সাথের মধ্যে ৬৫৪ বিলিয়ন ডলারে পণ্য উৎপাদনের সম্ভবনা রয়েছে। ২০১৩ সালে বিশ্বে ২৩৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের চাহিদা ছিল। ২০২০ সালে ৩৩৪ মিলিয়ন টন চাহিদা হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
দেশে অভ্যন্তরীণভাবে ২০ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে সরাসরি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১৩ কোটি ডলার আয় করছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গার্মেন্টস পণ্যের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন রফতানি হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার। চীনের বাজারে বাতিল প্লাস্টিক রফতানি বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সক্ষম হচ্ছে এ খাত। তবে বাতিল সামগ্রী ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট স্থান থেকে এনে রফতানি করতে পারলে এ খাতের আয় বছরে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে চীনের আমদানিকারকরা এসব বাতিল প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করে সিনথেটিক সুতা উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে আরও কয়েকগুণ বেশি মূল্য সংযোজনপূর্বক বিদেশে রফতানি করছে। দেশে বাতিল প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারের কারখানা স্থাপন করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সিনথেটিক ফাইবার উৎপাদন করা সম্ভব।
বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কিছু দেশে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে এই পণ্যের। এসব দেশে প্লাস্টিক রফতানির দিকে বেশি নজর দিলে এ শিল্পের সম্ভাবনা আরও অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বেশিরভাগ দেশে প্লাস্টিক পণ্য রফতানি হচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। এর মধ্যে গার্মেন্ট এক্সেসরিজ হিসেবে প্রধানত আমেরিকা, কানাডা ও রাশিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে বেশি। এই দেশে থেকে ওই সব বিদেশে হ্যাঙ্গার, বোতাম, পলিব্যাগ, ফিল্ম ব্যাগ, ক্লিপসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস রফতানি হয়।
দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ প্রায় ৫ হাজারে উপরে প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতে। এই খাতে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা থাকলে আরো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সরকার বর্তমানে প্লাস্টিক দ্রব্য রফতানিতে নগদ সয়হতা দিচ্ছে ১০ শতাংশ। তবে নগদ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত রেখেছে সরকার। প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদনের কোনো পর্যায়েই ডিউটি ড্র-ব্যাক সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া রপ্তানির বিপরীতে বন্ড-সুবিধাপ্রাপ্ত এবং ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের জন্য এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব শর্তের কারণে নগদ সহায়তার সুবিধা খুব বেশি পাচ্ছেন না রপ্তানিকারকেরা।
এদিকে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। এখন দেশে তৈরী প্লাস্টিকের অধিক টেকসই দরজা, চেয়ার-টেবিল, বালতি, আলমারি, র্যাগসহ নানা ধরনের গৃহসামগ্রী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অন্য জিনিসের থেকে কম টাকায় প্লাস্টিকের এই সব গৃহসামগ্রী পাওয়া যায়। এছাড়া কৃষিতেও ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিকে দ্রব্য। বাংলাদেশের শহর-গ্রাম-মফস্বলে যেসব স্বল্পমূল্যের প্লাস্টিকের খেলনা বিক্রি হয় কয়েক বছর আগেও তার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। কিন্তু গত দুই থেকে তিন বছরে সেই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়ে এখন এসব খেলনার একটা বড় অংশ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশেই। ক্ষুদ্র আকারে এই শিল্পটি গড়ে উঠেছে পুরনো ঢাকা এবং আশপাশের কিছু এলাকাকে কেন্দ্র করে।
সিডিপির এক প্রতিবদনে এ শিল্পকে উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করেছেন গবেষকরা। তাতে বলা হয়েছে, উন্নত যন্ত্রপাতি, ল্যাবে টেস্টের ব্যবস্থা, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চমানের প্রযুক্তি ব্যবহার। এছাড়া দেশি ও বিদেশি উচ্চ বিনিয়োগের কথাও বলেছেন তারা।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল ম্যানুফ্যাকচার মালিক সংগঠনের সভাপতি মো: আবু মোতালেব বলেন, ভ্যাট কমোর জন্য আমরা এর আগে আন্দোলন পর্যন্ত করেছি। তারপরও বর্তমানে প্লাস্টিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নেয়া হয়। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবাসয়ীরা ক্ষতি মুখে পড়ছে। অনেকের ব্যবসা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়নের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে বারবার আলোচনায় করেও কোন ফল পাচ্ছি না। এ শিল্পের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করলে তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অনেক খাতেই সরকার নগদ সহয়তা দিচ্ছে। প্লাস্টিক খাতেও নগদ সহায়ত দিচ্ছে, তবে অন্য খাতের তুলনায় কম। অন্য খাতের ক্ষেত্রে কোন শর্ত দেয়া হয়নি, শুধু প্লাস্টিক ও ফার্নিচার খাতেই এই শর্ত রাখা হয়েছে। এ কারণে অনেকই এই নগদ সহয়তা কাজে লাগাতে পারছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন