মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু কিছু জেলায় ডিসি ও জেলা পুলিশ সুপারদের মধ্যে কিছুটা বিরোধ চলছে। ডিসি বা পুলিশ কর্মকর্তারা যখন মিটিং করেন সেখানে অনেকে যান না বলে তথ্য পেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চলতি বছরের মে মাসে এটি গোপনীয় প্রতিবেদনেও নানা ধরনের বিরোধ ও মতানৈক্যসংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে সরকার। এসব মতানৈক্যের কারণে জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসপিদেরও কোনো কথা শোনেন না জেলা প্রশাসকরা। বিষয়টি সুরাহা করতেই পিআরবিতে উল্লিখত প্রবিধান স্মরণ করিয়ে দিয়ে ডিসিদের কাছে মামলা ও জিডির সংক্ষিপ্ত তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। তারপরও জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জেলার ডিসিদের মামলা ও জিডির তথ্য সরবরাহ করছেন না এ বিরোধ নিস্পত্তি চান ডিসিরা এবারেও প্রস্তাব তুলেছেন। এছাড়া রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে চান ডিসিরা।
আগামী সোমবার শুরু হচ্ছে তিনদিন ব্যাপী জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সম্মেলন। আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে এই সম্মেলন। এই সরকারের মেয়াদে আর মাত্র একটি ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধন করেন। এবার ডিসিরা মুক্ত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীকে পাচ্ছেন না। করোনার কারণে এবার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। এবার ডিসি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সেশন হবে ভার্চুয়ালের। প্রতিবছরই ঘটা করে এ সম্মেলন হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। এসব সমস্যার আলোকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবারের ডিসি সম্মেলনে সাম্প্রতিক সময়ের সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারের শীর্ষ মহল। ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে এ অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় কোন্দলে সৃষ্ট অরাজকতা নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল খুবই বিব্রত। একই সঙ্গে এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিশেষ করে টেন্ডার পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দল সরকারের অনেক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি রাস্তাঘাট, কালভার্ট বা সেতু নির্মাণসহ সরকারের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের মান নিয়েও নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিষয়গুলো সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখনই মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ না করলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এসব উন্নয়ন বুমেরাং হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। সে কারণে এখন থেকেই এ বিষয়টি কঠোর হাতে দমন করতে চায় সরকার। অনেক জেলায় আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ডিসিকে ডাকা হয় না। কেননা, ইতোমধ্যেই কিছু ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বন্যা এবং পাহাড় ধ্বস এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বেশ কিছু আলোচিত বিষয় থাকাছে। সরকারি নথিতে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ৯১ শতাংশের বেশি হলেও বাস্তবের চিত্র উল্টো। সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না বলে জানিয়েছেন একাধিক জেলা প্রশাসক। এমনকি বছরের পর বছর উপস্থাপনের পরও কোনো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না কখনো। এসব কারণেই ডিসিদেরকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আগামী নতুন ধরন ওমিক্রনসহ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। কিন্তু এর মধ্যেই ১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে তিনদিনের জেলা প্রশাসক। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দু-বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডিসি সম্মেলন। প্রথমে ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের কারণে তা পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৪ থেকে ১৮ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন হয়েছে। এরপর করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১) জেলা প্রশাসক সম্মেলন হয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মাঝে সামনা-সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সাধারণত প্রতিবছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২২ এর কর্মসূচি প্রকাশ করেছে। কর্মসূচি অনুযায়ী এবার সম্মেলনে ২১টি কার্য অধিবেশনসহ মোট ২৫টি অধিবেশন থাকবে। এর মধ্যে প্রথমদিন ৭, দ্বিতীয় দিন ৮ এবং তৃতীয়দিন ১০টি অধিবেশন থাকবে। তবে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে সেশন ভার্চুয়ালি হবে। এবার জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ভেন্যু রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন। প্রথমদিন ১৮ জানুয়ারি বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। ওই দিনই সন্ধ্যা ৬টায় ভার্চুয়ালি দিক-নির্দেশনা মূলক বক্তব্য দেবেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। দ্বিতীয় দিন বিকেল সোয়া ৪টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে স্পিকার শুভেচ্ছা বক্তব্য দিবেন। সন্ধ্যা ৬টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন প্রধান বিচারপতি।
কার্য-অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকেন। সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা লিখিতভাবে মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসিরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। অধিবেশনগুলো হয় সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে। কার্য অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
এবার দীর্ঘদিন ধরেই জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা কাজ করছে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জেলার ডিসিদের মামলা ও জিডির তথ্য সরবরাহ করেন না। করোনা প্রকোপের আগে হওয়া নিয়মিত ডিসি কনফারেন্সে জেলা প্রশাসকরা বারবার অভিযোগ করে আসছেন পুলিশ তাদের কোনো ধরনের সহায়তা করে না। এ বিষয়টি সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা।
ডিসিদের প্রস্তাব গুলো হচ্ছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বৃদ্ধি করতে স্থানীয় সব ধরনের ইজারা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে অংশ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের ডিসি। নিজস্ব আয় কম হওয়ায় অনেক উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব, হিসাব সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও গ্রাম পুলিশদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এমনকি চেয়ারম্যান ও সদস্যদেরও সম্মানী ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না এমন প্রস্তার দিয়েছেন ডিসিরা। উপজেলা পরিষদের কর্মচারীদের বদলির ক্ষমতা. প্রতি তিন বছর অন্তর জেলা পর্যায়ে আন্ত-উপজেলায় বদলির ক্ষমতা ডিসিকে এবং বিভাগীয় পর্যায়ে আন্তজেলা পর্যায়ে বদলির ক্ষমতা বিভাগীয় কমিশনারে হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেছেন ঝালকাঠির ডিসি। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, এই কর্মচারীরা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে চাকরির কারণে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ফলে অফিসের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটে এবং প্রশাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এতে প্রত্যাশিত সেবা বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হবে। বর্তমানে তাদের বদলির কোনো বিধান নেই।দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে মাঠকর্মীর পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছেন ভোলার ডিসি। গ্রাম আদালতের বেঞ্চ সহকারী/জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন কুষ্টিয়ার ডিসি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানী বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন যশোরের ডিসি। গ্রাম পুলিশ ও মহল্লাদারদের বেতন-ভাতা ও আনুতোষিক ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন চট্টগ্রাম, যশোর, বান্দরবান ও বরগুনার ডিসিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন