শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিরা ছয় ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

ছয় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি অপরাধীরা। এসব বিদেশি নাগরিকরা প্রতারণা, ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি, আদম পাচার, জাল ডলার ব্যবসা, মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। বিদেশি এসব অপরাধী ইন্টারনেটে, ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটএ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ নানা ধরনের পদ্ধতিতেও প্রতারণার ফাঁদ পেতে অপরাধ করছে। বিদেশি নাগরিকদের সহায়তা করছে অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছু এদেশের নাগরিক। ক্যামেরুন, ঘানা, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, ইথিওপিয়া, আলজেরিয়া, লাইবেরিয়াসহ ১৬টি দেশের নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
অন্যদিকে ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করছে প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি নাগরিকের কোনো হদিস পাচ্ছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তাদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে ভিসা নেই, এমন নাগরিকদের নিজ দেশে পাঠাতে বলেছে সরকার। অবৈধদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিসর, ব্রুনাই ও তুরস্কের নাগরিক রয়েছেন। বিমানবন্দরে এসেই তারা অন-অ্যারাইভাল ভিসা নেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করেন না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে লাপাত্তা ও অবৈধ বিদেশিদের বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ভিসার মেয়াদ শেষেও বাংলাদেশে অবস্থানরতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গ্রেফতারের পর তাদের সেফহোমে রেখে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশে কাউকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে দেয়া হবে না।
ডিএমপির সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের শনাক্তকরণ কাজ চলছে। একই সাথে যাদের স্পন্সরে ওই বিদেশিরা বাংলাদেশে এসেছেন তাদেরকেও শনাক্ত করা হচ্ছে। তদন্ত করে দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ভেতরে ৫০০ বিদেশির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালিকাভুক্ত বিদেশিদের যে ঠিকানা দিয়ে এসেছে ওই ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবৈধভাবে অবস্থান করার কারণে তারা ফরেনার্স এ্যাক্টও ভঙ্গ করেছে। ফৌজদারি অপরাধ ছাড়াও ফরেনার্স এ্যাক্টের অধীনে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভেতরে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের খুঁজে বের করে আটক করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ।
ওই সূত্র জানায়, এদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিরা ফুটবলার, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও পর্যটক হিসেবে এদেশে এসেছে। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা নিজ দেশে ফিরে যায়নি। এমনকি ভিসা নবায়নও করেনি। তার ওপর তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দেশীয় অপরাধীচক্রের সদস্যরা বিদেশি নাগরিকদের অপরাধ করার সঙ্গে সহায়তা করছে। এজন্য বিদেশি নাগরিকরা অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযান পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, এসবি ও গোয়েন্দা সংস্থা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গত দু’মাসে এ ধরনের অপরাধী চক্রের অর্ধ শতাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। ওসব অপরাধীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী আফ্রিকান নাগরিক যারা আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত তারা ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে গিফট দেয়ার নামে প্রতারণামূলকভাবে নিজ নিজ দেশের সহযোগী ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্র। তাদের সহযোগীরা উল্লেখিত প্রত্যেকটি দেশে অবস্থান করছে। তাছাড়া এদেশের রাজধানীতেই অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিক প্রতারণা, ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি, আদম পাচার, জাল ডলার ব্যবসা, মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে রয়েছে। বিদেশি ওসব অপরাধীরা ইন্টারনেটে, ফেসবুক, ইমেইল, হোয়াটএ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারসহ নানা ধরনের পদ্ধতিতে প্রতারণার ফাঁদ পেতে থাকে। আর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে লোভের বশীভূত হয়ে অনেকেই রিক্ত নিঃস্ব হচ্ছে। প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক ওই অপরাধী চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, ভিসার মেয়ার শেষ ও পাসপোর্ট নেই এমন ৪ হাজারের অধিক বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছে, এমন তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। এদের সবাই কোনো না কোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতারণা, ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি, আদম পাচার, জাল ডলার ব্যবসা ও মাদক পাচারের মতো অপরাধের সাথে এরা জড়িত রয়েছে। এদের সহায়তা করছে এক শ্রেণির বাংলাদেশী নাগরিক। র‌্যাব অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিক ও যারা এদের সহযোগিতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, আফ্রিকান এসব প্রতারক বায়িং হাউসের ব্যবসার নামে এবং বিভিন্ন ক্লাবে চুক্তিভিক্তিক খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশে আসে। তারপর তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের অপরাধমূলক কাজে দেশের বাইরে থেকেও অন্য বিদেশিরাও সহায়তা করছে। একইসঙ্গে দেশীয় কিছু লোক টাকার বিনিময়ে তাদের সঙ্গে কাজ করছে। ওসব প্রতারককে গ্রেফতার করে আদালতে তোলার পর তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। আর একবার জামিনের পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে ওই অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে না।
র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, সম্প্রতি ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান থানা এলাকা থেকে নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক প্লাটফর্মে সম্পর্ক গড়ে নিজেদের পশ্চিমা নাগরিক জাহির করে তারা প্রতারণা করে আসছেন। তাদের মতো যারা অবৈধভাবে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদেরও ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, গত ২২ জুলাই রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে এক বাংলাদেশী নারীসহ ১২ নাইজিরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুকে বন্ধুত্বের পর দামী উপহার দেয়ার নামে প্রতারণা করে গত কয়েক মাসে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এই চক্র। তারা অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে। বন্ধুত্বের একপর্যায়ে তারা একটি মেসেঞ্জার থেকে একটি উপহার পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। পরে মেসেঞ্জারে এসব মূল্যবান সামগ্রীর এয়ার লাইন বুকিংয়ে ডকুমেন্ট পাঠায়। এর পর এসব উপহারের বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানায়। এভাবেই প্রতারণায় শিকার হন বাংলাদেশীরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন